কাঠিয়া সম্প্রদায়ের প্রতীক কাষ্ঠ-বন্ধনী পরিধান সম্পর্কে কী বলেছিলেন বাবাজী মহারাজ

 


তারক ঘোষ

 

আমাদের সমাজ-ব্যবস্থা ও ধর্ম নিয়ে বাবাজী মহারাজ অসমের একটি টিভি সাক্ষাৎকারে অনেক কথাই বলেছিলেন। সমাজ ও ধর্মের সংষ্কারের পাশাপাশি, শিক্ষার সংষ্কার, ধর্মের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কুসংষ্কার নিয়ে তিনি দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেন। পাশাপাশি, সেদিন তিনি সন্ন্যাসীর বেশ ও কাঠিয়া সম্প্রদায়ের সাধুদের কাঠের আড়বন্ধনী ব্যবহার ও তার প্রয়োজনীয়তা নিয়েও অনেক কথা বলেছিলেন।

আমাদের এই সমাজে আমরা নানা সম্প্রদায়ভূক্ত সাধু-সন্ন্যাসী দেখতে পাই। এদের কেউ পরিধান করেন গেরুয়া, কেউ সাদা, কেউ রক্তাভ। কেউ জটা-দাড়ি রাখেন, কেউ বা মুন্ডিত মস্তক। সম্প্রদায়ের নিয়মকে এই সাধু-সন্ন্যাসীরা যেমন মান্য করে চলেন, তেমনি তাদের পরিধানকেও অসম্মান করেন না।

এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, একজন পুলিশ অফিসার বা সেনার কাছে তার ইউনিফর্ম কতটা মর্যাদার সেটা সকলেই জানেন। এই ইউনিফর্মকে অসম্মান মানেই দেশকে অসম্মান, ব্যক্তিকে নয়। ঠিক তেমনই, একজন সাধু তার পোশাকের মর্যাদাকে প্রাণ দিয়ে রক্ষা করেন। সন্ন্যাসের বেশ তাদের পাপ করতে বাধা দেয়, মাথার জটা প্রতিটি মুহুর্তে তাদের স্মরণ করিয়ে দেয় – “তুমি সন্ন্যাসী। তোমার এই জটাকে সাধারণ মানুষ সম্মান করে। বিশ্বাস করে, তুমি একজন সৎ সন্ন্যাসী। জটা-দাড়ি রেখে, সন্ন্যাসীর বেশ পরিধান করে এমন কাজ কোরোনা, যাতে তোমার ভক্তদের, সাধারণ মানুষের বিশ্বাসটা নষ্ট না হয়। এই জটা-দাড়ি-বেশের মর্যাদা রক্ষা করাটাও তোমাদের কাজ এবং সবচেয়ে বড় কাজ, কেননা, এই বেশ তোমাদের সংযমের মধ্যে রাখে।“



যদিও, আজ এই সমাজে বহু নকল সন্ন্যাসী আছে, যারা এই জটা-দাড়ি-বেশকে নিজেদের আখের গোছানোর জন্য, কিংবা পুলিশের চোখে ধোঁকা দেওয়া জন্য ব্যবহার করে। সেটা ভিন্ন প্রসংগ।

 আমাদের বাবাজী মহারাজও খুব গুরুত্ব দিতেন এই বেশ এর সম্মান রক্ষার ব্যাপারে। কাষ্ঠবন্ধনী প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি অসমের টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন – ইন্দ্রদাসজী নামে এক পুরুষ এসেছিলেন এই সম্প্রদায়ে। তিনি দেখলেন, তার  নবাগত শিষ্যদের অপ্রয়োজনে নিদ্রা আসে, আলস্য আসে, ব্রম্ভচর্য্য রক্ষার ক্ষেত্রেও অসুবিধা দেখা যায়। তাছাড়া আর একটা জিনিষ লক্ষ্য করলেন, কাপড়টা পরিধান করতে অনেক অসুবিধা হয়, কারণ তাদের জন-সমাজে যেতে হয়।

বাবার কথায়, এই কাষ্ঠবন্ধনী কাঠিয়া সম্প্রদায়ের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে এটাকে প্রতীক বললেও এই প্রতীকের প্রয়োজনীয়তা যথেষ্ট রয়েছে।  এই বন্ধনী লোভকে, আলস্যকে কাছে আসতে দেয় না। এই কটি-বন্ধনীর সঙ্গে যুক্ত ল্যাঙ্গোটি ব্রম্ভচর্য্য রক্ষা করতে সাহায্য করে।

বাবা বললেন, এই কাষ্ঠবন্ধনী আমাদের আরাম থেকে দূরে রাখে, যেটা আমাদের কাছে প্রয়োজনীয়। এই বন্ধনী আমাদের ভালোভাবে শুতে, বসতে দেয় না। ফলে, আমরা তামসিকতা থেকে রক্ষা পাই।

এই কাষ্ঠবন্ধনী থেকেই জনসমাজে কাঠিয়াবাবা নামটির প্রচলন হয়। বাবা বললেন, তার শ্রীগুরুও, পূর্বের রীতি মেনে কাঠিয়া শব্দটাই ব্যবহার করতেন। কাষ্ঠবন্ধ ধারণ করা হয় বলেই কাঠিয়া। মানুষজন সম্মান দিয়ে ‘কাঠিয়াবাবা’ বলেন।



এই আড়বন্ধ দেহকে সাধন-ভজনের উপযুক্ত করে। তিনি  বললেন, ‘আমি যদি কোন গর্হিত কাজ করতে যাই, বা কাউকে অন্যায়ভাবে আঘাত দিতে যাই, বা যে কাজ ঠিক নয়, তা করতে যাই, সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়বে, আমি এই আড়বন্ধ ধারণ করে রয়েছি। মানুষ আমাদের কাছে থেকে অনেক কিছু আশা করে। কাজেই এটা একটা গার্ড। একদিকে শারীরিক দিক থেকে একটা সুরক্ষা, অন্যদিকে, মানসিক সুরক্ষা দেয় এই আড়বন্ধ।

অনেকে বলেন, বৃদ্ধ হয়ে গেলে কি আর এই আড়বন্ধের প্রয়োজন হয়? তখন তো আর ব্রম্ভচর্য্য রক্ষার দরকার পড়ে না।

বাবাজী মহারাজ বললেন, শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যে আচরণ করে যান, আমরা তাকেই অনুসরণ করে চলি। ‘আপনি আচরি ধর্ম/জীবেরে শেখাও’

এটা একটা প্রতীক। এর অর্থ হল, নিজেকে সংযমের দ্বারা, ব্রম্ভচর্য্যের দ্বারা বেঁধে ফেলা। এটা প্রয়োজন।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad