বাবাজী মহা্রাজ আমাদের বললেন, “শ্রীকৃষ্ণ শুধু প্রেমের দেবতা নন, তিনি বিপ্লবের দেবতা, কর্মের দেবতা।“

 


গার্হস্থ্য জীবনে ভগবানকে পাওয়ার সহজ পথ হলো ভগবান যে কর্মে আমাকে দিয়েছেন, তা নিষ্ঠার সঙ্গে সুন্দরভাবে এবং অনলসভাবে করে যাওয়া আর এর বিনিময়ে কিছু না চাওয়া। 


 তারক ঘোষ


কর্মই আমাদের একমাত্র ভরসা। কর্মের মাধ্যমেই ঠিক হয়ে যায় আমাদের ‘কর্মা’। আমাদের প্রতিটি দিনের কর্মই বদলে দিতে থাকে আমাদের ভাগ্য। আর যারা কর্ম ছেড়ে আলস্যে দিন কাটান বা মনে করেন, শুধু ধর্মাচরন করলেই ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন, তাদের উদ্দেশ্যেও একটা ভালো কথা আমদের ধর্মগুরুরা বলে গেছেন- তুমি এক পা এগোলে, তবেই ভগবান, দু-পা এগিয়ে আসবেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন- এক হাতে ঈশ্বরকে ধরে রাখো, অন্য হাতে কর্ম করো। কর্ম ত্যাগ করে আলস্যে জীবন কাটানো বাবাজী মহারাজ একেবারেই পছন্দ করতেন না। পাশাপাশি তিনি বলতেন, শুধু নিজের স্বার্থে কাজ করলে, কোন সমাজ উপকৃত হতে পারে না।



তিনি মনে করতেন, আগে শরীর, তারপর ধর্মশরীরং আদ্যং খলু ধর্ম সাধনং আর শরীর রক্ষা করতে বাবাজী গুরুত্ব দিতেন সংযমের উপর সংযম অভ্যাস করতে পারলে ষড়রিপু কাউকে বিপদে ফেলতে পারে না অন্যের উন্নতি দেখে মানুষের লোভ পরশ্রীকাতরতা তখনই সৃষ্টি হয়, যখন তার সংযম থাকে না এই কারণে, বাবাজী সংযমকে জীবন গঠনের মূল্যবান উপাদান মনে করতেনআর নিঃষ্কাম কর্মের পিছনে থাকে  সংযমের এক বিরাট ভূমিকা।

গীতার ‘কর্মযোগ’ অধ্যায়ে শ্রীভগবান বলছেন –

“নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হি অকর্মণঃ।

শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিদ্ধ্যেদকর্মণঃ।।“

এর অর্থ হল- তুমি নিত্য কর্ম কর, যেহেতু কর্ম না করা অপেক্ষা কর্ম করা শ্রেষ্ঠ। কর্ম পরিত্যাগ করলে তোমার শরীরযাত্রাও নির্বাহ হবে না।

বাবাজী মহারাজ এই শ্লোকের ব্যাখ্যায় বললেন – “যতই অন্তরে ভক্তিভাব থাকুক, কর্মে উদাসীনতাকে কখনো প্রশ্রয় দিতে নেই। ভাবুকতার আশ্রয় নিয়ে কর্তব্য-কর্মে অবহেলা করলে, বা কর্মে তাচ্ছিল্য বোধ এলে, তমোগুণ সাধকের সর্বনাশ করে ছাড়ে। তাই, শ্রীভগবান নিত্যকর্ম ঠিক ঠিক পালনের কথা বলেছেন।“




এই প্রসঙ্গে স্বামী শ্রীশ্রী জানকীদাসজী মহারাজ বলেছেন – কর্তব্য সব সময় নীরসই হয়। অলসতা-বশতঃ কর্ম ত্যাগ করলে ভগবান লাভ তো দূরের কথা, শরীরও অকেজো হয়ে ব্যাধির বাসস্থান হয়ে যায়।

একবার কিছু ব্যক্তি গিয়ে দেখলেন শ্রীসন্তদাসজী মহারাজ ঠাকুরের পোড়া বাসন মাজছেন। তারা তো এই দৃশ্য দেখে হতবাক। একজন জিজ্ঞাসা করলেন – ‘আপনার বাড়িতে ১৮ জন চাকর আছে কাজ করে দেবার জন্য, আর আপনি এখানে বসে বাসন মাজছেন?’ তিনি এর উত্তরে বললেন, ‘আমি কিছু সময় জপ করি, কিছু সময় পুজো করি, কিছু সময় সদগ্রন্থ পড়ি, বাকি সময় শ্রীঠাকুরজীর কাজ করি।‘ প্রশ্ন উঠতে পারে, এই কথায় তিনি কী বোঝাতে চেয়েছিলেন? আসলে সাধককেও কর্ম করতে হয়। শুধু নিজে জপ-তপ নিয়ে ব্যস্ত থেকে, অন্যকে দিয়ে ঠাকুরের কাজ করালে হয় না, নিজেকেই করতে হয়। শুধু গুরু সেজে বসে থাকলে হবে না, এই জগতের জন্য, মানুষের জন্য কর্ম করতে হয়, যে কর্মে জীব-জগতের মঙ্গল-সাধন হয়। স্বামী শ্রীজানকীদাসজী মহারাজ এই প্রসঙ্গে বলেছেন –‘তা না হলে বাইরে সাধু সাজা যাবে এবং কিছুদিন পুজোও পাওয়া যাবে, কিন্তু সাধকের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যাবে।‘




আর গার্হস্থ্য জীবনে ভগবানকে পাওয়ার সহজ পথ হলো ভগবান যে কর্ম আমাকে দিয়েছেন, তা নিষ্ঠার সঙ্গে সুন্দরভাবে এবং অনলসভাবে করে যাওয়া আর এর বিনিময়ে কিছু না চাওয়া। সংসারে যারা কর্মযোগের সাধনা করেন, ভগবান তাদের সামনে অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে দেন। মাঝে মাঝে, তাদের সামনে  বহু বাধা-বিঘণ, অপমান ও বিরুদ্ধ পরিবেশও তিনিই সৃষ্টি করে দেন। পরীক্ষা নেন, তারা হাসিমুখে ঈশ্বরের প্রতি একই বিশ্বাস রেখে তাদের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেন কিনা দেখার জন্য। এইভাবেই স্থিরপ্রতিজ্ঞ, নিঃষ্কাম কর্মযোগী ব্যক্তিরাই এই সমাজ-সংসারে সুপ্রতিষ্ঠিত হন।

আসলে আমরা ঈশ্বরের সিসিটিভি সারভিলেন্সের মধ্যে আছি। কোন একজন, কম্পুটারের স্ক্রীনে আমাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছেন। সব রেকর্ড হয়ে থাকছে। আর সেই ভাবে বদলে যাচ্ছে, আমাদের ভাগ্য। 



বাবাজী মহারাজ বলতেন - কেউ হয়তো শেষ জীবনে, কেউ হয়তো মাঝপথেই তার প্রাপ্য পেয়ে যান। বোকা আমরা বুঝতে পারিনা, যে কষ্ট, দুঃখ, নির্যাতন আমরা পাচ্ছি, যে কটু বাক্য আমরা শুনতে পাচ্ছি, তা আমাদেরই ফেলে আসা কর্মের প্রতিফলন। যে কটু বাক্য আমরা শুনছি, সেগুলো আমাদেরই অন্যায়ভাবে কাউকে বলা কথারই প্রতিধ্বনী।

আর আমাদের যে কর্ম করতে হবে নিঃষ্কাম কর্ম। কেমন সেই কর্ম। এই প্রসঙ্গে জয়দোয়াল গোয়েন্দকার লিখেছেন - কোন লোক যদি টাকা-পয়সার স্বার্থ ত্যাগ করে দেয়, কিন্তু শরীরের আরাম ত্যাগ না করে, সে কামুক। শরীরের আরাম ত্যাগ করলো, কিন্তু মান-সম্মান ত্যাগ করল না, তাহলেও সে কামুক। যে দেহের আরাম, মান-সম্মান, অর্থ সব কিছুর স্বার্থ ত্যাগ করে কর্ম করল, তাকেই নিষ্কাম কর্ম বলে। 

সংসারী মানুষ বেশিরভাগ সকামভাবে কর্ম করেন। তাই তাদের পাপ-পূণ্য স্পর্শ করে। নিষ্কাম ব্যক্তির পাপও নাই, পূণ্যও নাই। কা্ঠিয়াবাবার কথায় –‘যিসকা ধন, উসকা পূণ্য, সাধুকা না পাপ, না পূণ্য। 

মনে রাখতে হবে ক্ষুদ্র ফলের আশায় কর্ম করলে, সে কর্মবন্ধনে বদ্ধ হয় ও সংসার স্রোতে ঘুরতে থাকে। 'বিনিময়ে কী পাব' – এই আশায় কর্ম না করে, ‘কর্মে আমার অধিকার, ফলে নয়’ – এইভাবে কর্ম করলে সেটাই নিষ্কাম কর্ম। আপনি যদি ভবিষ্যতে সন্তান আপনাকে দেখবেভেবে তার পিছনে অর্থ খরচ করেন, মানুষ করেন; আর ভবিষ্যতে যদি সে না দেখে, তাহলে হা-হুতাশ করেন, তাহলে বুঝতে হবে, আপনি নিষ্কাম কর্ম করেন নি, স্বার্থ নিয়ে সন্তানকে মানুষ করতে চেয়েছিলেন

 তাই আপনাকে সেটা ফিরে পেতেই হবে।

মনে রাখবেন, কর্মে আপনার অধিকার অর্থাৎ সন্তানকে মানুষ করা আপনার কাজ- ফলে আপনার অধিকার নেই, অর্থাৎ, সে দেখল, কি, না দেখল, সেদিকে আপনি তাকাবেন না। এইভাবে সন্তান মানুষ করতে পারলে, সেই সন্তান অবশ্যই তার কর্তব্য করবে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। 

কারণ, মনে রাখতে হয়, আশ্রমে দান করা আপনার কর্তব্য, কিন্তু, প্রতিদান পাওয়ার আশায়, ‘ইনভেস্টমেন্টহিসাবে দানকরলে, পরোক্ষে তা ক্ষতির কারণ হয়। আমি বহু ব্যবসায়ীকে দেখেছি, কীভাবে সুবিধা ভোগ করার আশায়, আশ্রমে কালো টাকা দান করেন। তারপর সেই আশ্রমের সাধুদের কন্ট্রোল করে নিজের স্বার্থ-সিদ্ধির চেষ্টা চালান। এতে শেষপর্যন্ত ক্ষতিই হয়। 

যিনি স্বার্থ নিয়ে অন্যায় অর্থ দান করেন, তার, আর যিনি সব জেনেশুনে গ্রহণ করেন, তারও।

তাই, বাবাজী বলছেন –‘কর্মে উদাসীনতাকে বৈরাগ্য বলে না। এটা অমনোযোগমাত্র। যে কর্মে মনোযোগী হতে পারে না, সে জপ-ধ্যানেও মনোযোগী হতে পারেনা। তাইতো নিষ্কাম  কর্মকে  পূজা বলা হয়েছে, সাধনা বলা হয়েছে।




গীতায় বলা হয়েছে – নিঃষ্কাম কর্ম মানে শ্রীভগবানে প্রসন্নতার জন্য কর্ম। এই কর্ম আর নতুন ফল উৎপন্ন না করে ঈশ্বর চরণে বিলীন হয়ে যায়। আর অন্যদিকে, মানুষ যদি নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য, কর্মফলের আশায় কর্ম করে, তাহলে সে কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং সংসার স্রোতে ঘুরতে থাকে।

দেখবেন, এই জগতে যারা বিখ্যাত হয়েছেন, তারা নিজেদের শিক্ষা, জ্ঞানকে সকলের জন্য ছড়িয়ে দিয়েছেন। একজন সাধারণ, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়রকে কারো মনে রাখার দায় নেই, কারণ, তারা নিজেদের স্বার্থে অর্থ উপার্জন করছেন, কিন্তু, যে জীববিজ্ঞানী ্বা পদার্থ বিজ্ঞানী তাদের নিরলস গবেষণার দ্বারা জীব-জগতের সামনে নতুন কিছু তুলে দিচ্ছেন, তারাই মানুষের মনে থাকেন। এই কারণে, চিরজীবী হন, শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, অভিনেতারা। একজন ধনী মানুষকে কারো মনে রাখার দায় নেই, যতক্ষণ না, তিনি নিঃস্বার্থে দেশের ও দশের মঙ্গলের জন্য কিছু করছেন।

বাবাজী বলতেন, শ্রীকৃষ্ণ বিপ্লবের দেবতা। সত্যিই তাই। পাপে ছেয়ে যাওয়া ধরণীকে তিনি বারবার পাপ-মুক্ত করেছেন। প্রয়োজনে আবার আসার অঙ্গীকারও করেছেন।

গীতায় শ্রীভগবান বলছেন,-

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।

হে ভারত! যখনই যখনই ধর্মের হানী ও অধর্মের আধিক্য হয়, তখনই তখনই আমি নরদেহ ধারণ করে ভূভার-হরণে অবতীর্ণ হই’। বিপ্লবের বিষম ঘুর্নিঝড়ে নিপতিত ভেঙে যাওয়া ভারতকে তিনিই  রক্ষা করেছিলেন। প্রয়োজনে আবার আসবেন।

 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad