পরে সেই ২০১৮ সালে বৃন্দাবনে বাবাজীর আশ্রমে ওনার কাছ থেকে মন্ত্র পান আমার স্ত্রী। কোভিডকালে বিষ্ণুদাসজী বাবার কাছে পাড়ি দেন অমৃতলোকে।
এর পরের ঘটনার আরো আশ্চর্যজনক।
২০২১ সালে এপ্রিল-মে মাসে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন, দিল্লি যখন প্রায় শ্মশানে পরিণত, তখন আমাদের পরিবারে সবারই করোনা হয়। মা (৬৮ বছর), আমি, আমার স্ত্রী, দুই কন্যা ( ৬ বছর ও আড়াই বছর) স্কলেই আক্রান্ত হই। ওই এক-দেড় বছরে তিনবার করোনা হলেও, ২০২১ সালের ‘ডেল্টা’ ভেরিয়েন্ট ছিল মারাত্মক রকম। অ
ফিসের whatsapp group থেকে বেরিয়ে যেতে হলো রোজই তরতাজা প্রাণ যেতে দেখে। হাসপাতালে জায়গা নেই, অক্সিজেন নেই, এম্বুলেন্স নেই, দেখার লোক নেই।
এমন সময়, মা আমায় বললেন, “আমায় হাসপাতালে ভর্তি করে দে। কষ্ট হচ্ছে।“
আমি বললাম, “তোমার যা হচ্ছে বলো, বিছানায় করলে কর। আমি সব করব, কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি করব না।“
এদিকে, স্ত্রীও দুটি মেয়েকে নিয়ে পেরে উঠছে না। একজনের বমি পরিষ্কার হলো তো, আরেকজন করছে। করতে করতে মেঝেতে পড়ে আমরাই জ্ঞান হারাচ্ছি। এইভাবে প্রায় ৭ দিন কেটেছে। যখন সবাই একটু ভালো, মায়ের পাশে বসে সারাত অক্সিজেন, সুগার না মাপলেও চলে, আমি পড়লাম অসুস্থ হয়ে। আমার ৭-৮ দিন কোনো জ্ঞান ছিল না। যখন একটু সুস্থ হলাম, মেয়েদের হাত ধরে হাঁটা শিখলাম, চোখ চেয়ে দেখলাম, আমার শরীরে অজস্র কাটা-ছেড়ার দাগ।
স্ত্রী বললেন, দরজা-আলমারীতে ধাক্কা খাওয়ার দাগ। অথচ, আমার একটুও ব্যথা নেই।
এই সাত-আট দিন আমি কোথায় ছিলাম জিজ্ঞাসা করলে, আমি একই উত্তর দিয়েছি –‘বাবাজীর কাছে’। ছোট্ট শিশুর মতো বাবার চারিদিকে ঘুরে বেড়িয়েছি, কোলে চড়েছি, আনন্দে কাটিয়েছি।
এদিকে, আমার স্ত্রী, মা ও দুই কন্যা আমার শরীরের জন্য খুবই চিন্তায়-কষ্টে ছিল। স্ত্রী আমায় পরে একরাত্রে জানান যে, একরাতে তিনি বাবাকে সশরীরে দেখেন। তারপর, থেকে চিন্তা করা ছেড়ে দেন। বাবাজী সেইসময় আমাদের সকলের দায়ত্ব নিজে নিয়ে কীভাবে সারাক্ষণ পাহারা দেবার মতো পায়চারি করছিলেন, তা আমার স্ত্রী অনুভব করেন।
এর মধ্যে, বাবাজী একদিন আমার স্ত্রীর কাছে জানতে চান, আমার প্রাণ রক্ষা করবেন কি না। এরপর, সেই রাতেই আমার স্ত্রীকে দীক্ষা-মন্ত্র দান করেন।
এই অভিজ্ঞতা আমার নয়, আমার স্ত্রী কাকলি সুরের। তার অনুমতি নিয়ে লিখলাম। কনফার্ম করার জন্য নয়, কৌতুহলের বশে আমার স্ত্রীকে দীক্ষা মন্ত্র বলতে বললে উনি যা বলেন, সেটা সঠিক।
আমার কাছে আশ্চর্য হওয়ার আর কিছু নেই। কারণ, আমি বাবার ক্ষমতা যে অসীম তা জানি। আমার কষ্ট এই জন্য হয়, যে বাবা আমাকে এতো স্নেহ করতেন ও করে চলেছেন, তার যোগ্য আমি কিনা, এই জন্যই।
আরো অনেক ঘটনা, যা বলে শেষ করা যাবে না।
ওইরকম অসুস্থতা থেকে বাবা আমাকে উঠিয়ে দেওয়ার পরও প্রায় দেড়-দু মাস এইরকম ঘটনা রোজই ঘটতে থাকত, যার দু-একটি না বললেই নয়। আমার মাকে বাবাজী বকাঝকা করেছিলেন, আমার জপের মালা গঙ্গায় ফেলে দেওয়ার অপরাধে।
একদিন আমার স্ত্রী শুধু ভাত রান্না করতে পেরেছেন। আর কিছু রান্না করতে দিচ্ছে না ছোট মেয়ে। শুধু মায়ের কোলে থাকছে। আমাকেও দেখাশোনা করতে হচ্ছে, এরকম অবস্থায় ঠাকুরের কাছে কান্নাকাটি করা ছাড়া তার আর কিছু করার ছিল না।
হঠাত, দরজায় আওয়াজ। দুর্গাপুজো কমিটির গোপালদাদা হাতে একটা বড়ো টিফিন বক্সে ডাল, তরকারী ও ভাজাভুজি নিয়ে হাজির।
এসে বললেন, “পার্থ নাকি বৌদির কাছে ভোগ খেতে চেয়েছে।“
সবাই অবাক।
সেই সময়টা এমনই যে, টাকা থাকলেও খাবার পাওয়া যেত না, কেউ কাউকে সাহায্য করতে যেতে ভয় পেত। এমন অবস্থায়, গোপালদাদা স্বয়ং ঠাকুরজী, নেপালদাদা বলভদ্রের মতো পাশে এসে দাঁড়ান।
যখন, বাইরের পরিস্থিতির একটু উন্নতি হয়েছে, দোকান-পাট খুলতে শুরু করেছে, কাছের একটি ছোট হোটেল থেকে দু-বেলা ডাল-তরকারী-রুটির ব্যবস্থা করেছিলেন আমার স্ত্রী নিজেই।
আমি তখন আগের মতো নেই। ভোর তিনটেয় উঠি। স্নান করে তিলক-স্বরূপ করি, (প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, ২০০৬ সাল থেকে আমার তিলক-স্বরূপ করা বন্ধ হয়ে যায়।) পুজো করি, বাগানে প্রচুর কাজ করি, শরীরের বলের অতিরিক্ত কাজ। স্যানিটাইজার খেয়েছি চরণামৃত ভেবে, কিছুই হয়নি। সবই বাবার ইচ্ছা ছাড়া আর কিছু নয়।
আরেক দিন, হোটেলের খাবার আমি খাওয়ার পর, বাড়ির অন্যরা খেতে গিয়ে তাতে কেরোসিনের গন্ধ পায়। আমিও তখন দেখি, হ্যা, সত্যি, কেরোসিনের তীব্র গন্ধ। অথচ, তার একটু আগে আমি ওই খাবারই খেয়েছি। একটুও গন্ধ পাইনি।
পরে হোটেলের ওই লোকটি ক্ষমা চেয়ে যায়। সে নাকি কয়লাতে কেরোসিন দিতে গিয়ে, খাবারে পড়ে যায় বলে।
মীরা বাঈকে দেওয়া বিষের পেয়ালা যেমন তার ক্ষতি করতে পারেনি, বাবাজীর কৃপায় কেরোসিন আমাদের কিছু করতে পারেনি।
২০০৪ থেকে ২০২২ সালের শেষে বসে যখন লিখছি, আমার সম্বল বলতে বাবাজীর দেওয়া মন্ত্র বলতে আর কিছু নেই। আর আছে ওনার দেওয়া শিক্ষা, যার কিছুটা মেনে চলার চেষ্টা করি মাত্র। তমো ও রজঃ গুণের আধিক্য, সত্ব গুণের তুলনায় বেশি আমাদের মধ্যে। তাই ওনার মতো জপ-ধ্যান করে উঠতে পারিনা।
একজন ছাত্রের কেমন হওয়া উচিত বাবার মুখে শুনেছিলাম –
শন নিদ্রা, কাক চেষ্টা, বক ধ্যানম।
অর্থাৎ, কুকুরের মতো নিদ্রা, কাকের মতো বারবার চেষ্টা আর বকের মতো একপায়ে লক্ষ্যের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে অধ্যাবসায় করা।
বাবা হলেন, জ্ঞানের ভান্ডার। সমাজের এমন কোনো শ্রেণির মানুষ নেই, যারা ওনার উপদেশে উপকৃত হননি। তিনি শিক্ষকেরও শিক্ষক। ভাগবত-পুরাণ-গীতা-রামকৃষ্ণ কথামৃত-রবীন্দ্রনাথ- তার প্রতি পাঠেই উঠে আসতো। লোকশিক্ষার মাধ্যমে সমজকে কুসংষ্কারমুক্ত করে, প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে গীতার সংযোগসাধন করে, লাইব্রেরী, দাতব্য চিকিতসার ব্যবস্থা করে, সমাজকে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন, আগামি দিনে কীভাবে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, কর্মযোগ, কর্ম-সন্ন্যাসযোগের এমন মেলবন্ধন সহজে দেখা মেলা ভার। এ
ত কর্মকান্ড করেও তিনি নির্লিপ্তভাবে সবার উর্ধে ছিলেন
যাক, আমি জীবন মূল্যায়ন করার মতো ধৃষ্টতা যেন না করি। যদি অজান্তে কিছু করি, বাবা যেন আমায় ক্ষমা করেন। আর আমি আমার জীবনের মূল্যায়ন করে আপনাদের অমূল্য সময় নষ্ট করব না। আর একটা কথা মনে পড়ছে। বাবাজী যেদিন তার গোল্ড মেডেল নিয়ে আশ্রমে এসে দাদাজীকে দেখাতে যানুনি তখন ওই মেডেলটি রেখে বাবাজীকে টয়লেট পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। যাতে ওনার মনে অহঙ্কার বাসা না বাধে। আর তিনি তাই কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি না নিয়ে মানুষের কল্যাণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করে।
একটি গল্পের উল্লেখ করে আমি এই অনুভূতির ইতি টানবো।
‘কৌপিন কা ওয়াস্তে’ শিরোণামে একটি গল্প শুনেছিলাম।
এক সাধু তার গুরুদেবের কাছে সন্ন্যাস নিয়ে একটি পর্ণ-কুটিরে সাধন-ভজন করতেন। তার কুটিরে ইদুরের এতো উপদ্রব ছিল যে তার কৌপিন পর্যন্ত কেটে নষ্ট করে দিত। গ্রাম থেকে রোজ নতুন নতুন বস্ত্র না এনে, একটা বিড়াল আনার প্রস্তাব দেন একজন। যেমন কথা, তেমনই কাজ।
বিড়াল পুষলেন। ইঁদুর সব ভেগেছে। কৌপিন এখন সুরক্ষিত। কিন্তু, বিড়াল খিদেতে সর্বক্ষণ মিউ মিউ করে। তার শব্দের জপ-ধ্যান বন্ধ। সুরাহা করতে গাভী পুষতে হলো।
এবার, বিড়াল ও সাধুজীর খাবার পরও দুধ অতিরিক্ত হওয়ায় দুধ বেচতে হলো। সাধুজীর দুধে জল নেই। তাই চাহিদা বাড়লো। গরুর সংখ্যা বাড়লো। গরুকে বাঘের হাত বাঁচাতে পাকা খাটাল হলো, একটি ছেলেকে রাখতে হলো। গরুকে খাওয়াতে ও সাধুর জন্য গ্রামের লোকেরা জমি দান করল। সেখানে চাষ হতে লাগলো।
ক্রমে, পর্ণ কুটিরের জায়গায় পাকা বাড়ি হলো। সবকিছু থেকে অর্থ উপার্জন এতই বাড়লো যে সিন্দুক কিনতে হলো, দাড়োয়ান, হিসাব রাখতে খাজাঞ্চি- তাদের খাওয়া-দাওয়া করাতে বড়ো রসুইখানা। শেষে এতো লোক, যেন মনে হতো জমিদার বাড়ি। এমন সময়, ওই সাধুজীর গুরুদেব এসে হাজির।
অবাক হয়ে তার সাধু শিষ্যকে খুঁজতে শেষ দেখেন তার সব কর্মকান্ডের কথা। সাধু শিষ্য তার গুরুদেবকে বলেন, “এসব যা দেখছেন সবই হলো ‘কৌপিন কা ওয়াস্তে’।
গুরুদেব বলেন যে করেছিস কীরে! এই বলে তাকে সঙ্গে নিয়ে সাধন-ভজন করতে যেতে বললে ওই সাধু শিষ্যের ভুল ভাঙ্গে ও সবকিছু ছেড়ে চলে যান ওনার সাথে।
আমার জীবনও তেমনই। ‘মা কা ওয়াস্তে।‘ হয়ে গেছে। মায়ের জন্য ফিরলাম। চাকরি করছি। একা থাকতে দিল্লির ফ্ল্যাটে সারাদিন ভয়ে কাটে। তাই, তাড়াতাড়ি বিয়ে কর। এখন আমার দুই সন্তান, মা ও স্ত্রীকে নিয়ে কোথাও গেলে বাইকে ধরবে কী করে! তাই গাড়ি কেনা হলো।
অপেক্ষায় আছি বাবার জন্য।
আমাকে বলবেন, ‘কি করেছিস পার্থ? চল, আমার সঙ্গে। জপ-ধ্যান করব।'
সমাপ্ত