শিষ্যের সন্তাপ অপহারক গুরুর সংখ্যা খুবই কম, কিন্তু বিত্ত অপহারক গুরুর সংখ্যা অনেক
“গুরবো বহবঃ সন্তি শিষ্যবিত্তাপহারকঃ।
দুর্ল্লভোহয়ং গুরুর্দেবি শিষ্যসন্তাপহারকঃ।।"
তারক ঘোষ
শ্রীবাবাজী মহা্রাজ তার গুরুদেব সম্পর্কে লিখছেন – “গুরুদেবকে প্রয়োজন হলে স্ত্রীর মতো পরামর্শ দিতে হয়। ভৃত্যের মতো সেবা করতে হয়, পুত্রের মতো অনুগত থাকতে হয়, আবার প্রয়োজন পড়িলে বন্ধুর মতো সাহায্য করিতে হয়। বাবা এইরূপ সর্বোভাবেই শ্রী গুরুদেবের সেবা করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু, বেশিরভাগ ভক্ত শিষ্যই ‘গুরু ভগবান’, ‘গুরু ভগবান’ বলিতে থাকেন। কিন্তু, গুরুদেব যথার্থ কী চাহিতেছেন অবৈরাগ্যের কারণে, ভাবুকতার জন্য, জ্ঞানের অভাবে তাহারা তাহা বুঝিতে পারেন না। ইহাতে গুরুদেবের খুব ক্ষতি হইয়া যায়।
অনেকে কথায় কথায় ‘জয়রাধে’, ‘জয়রাধে’ বলিতে থাকেন। বাবার মুখ থেকে আমরা কোনদিন এইরূপ কথা শুনি নাই। এইজন্য, অনেকে ওনাকে অহঙ্কারী বলিতেন। কেহ কেহ বলিতেন, আপনি(শ্রীশ্রী স্বামী জানকীদাসজী কাঠিয়াবাবা) বাবার (শ্রীশ্রী স্বামী ধনঞ্জয়দাসজী কাঠিয়াবাব) সঙ্গে যখন আসেন, তখন কত হৈ-চৈ, কত ফূর্তি হয়।
বাবা বলিতেন, কি করিব! আমার স্বভাবটাই এই।“
শ্রীবাবাজী মহারাজ ছিলেন কর্মযোগী। এই সমাজ-সংসারকে নতুনভাবে গড়তে চেয়েছিলেন। মূলতঃ নতুনগ্রামে তার শ্রীগুরুর নামে আশ্রম প্রতিষ্ঠার পিছনে ছিল, সামগ্রিকভাবে এলাকার উন্নতি সাধন। তিনি বুঝেছিলেন এই একবিংশ শতাব্দীতে শুধু ধর্মের মধ্য দিয়ে নয়, নতুন প্রজন্মকে তুলে আনতে হবে, ধর্ম, কর্ম আর শিক্ষার মাধ্যমে।
কারণ, শিক্ষা মানুষকে ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য চিনতে শেখায়। শিক্ষা মানুষকে শুধু কর্মের যোগ্য করেই তোলে না, তার অন্তরের বিকাশ সাধন করে। তাই, তিনি নতুনগ্রামকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য এগিয়ে আসেন তার গুরুদেব নামাঙ্কিত বিদ্যালয় স্থাপনে। এলাকার ছেলেমেয়েদের যাতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অগ্রদ্বীপ যেতে না হয়, তারই একান্ত প্রয়াস। স্থাপন করেন পাঠাগার। কাঠ-পুতুল শিল্পের কারিগরদের সাহায্যে বাড়িয়ে দেন হাত। এটাই তো একজন মহামানবের কাজ।
সংস্কার-সাধন। শুধু মনের নয়, সমাজের সর্বস্তরে। মানুষের পূর্ণ বিকাশের জন্য, প্রথমেই চাই শিক্ষা। কারণ, শিক্ষাই বুঝতে শেখাবে ধর্মের মূল কাজ কী।
শ্রীবাবাজী মহারাজ লিখছেন, “ভক্তের নির্বিচার ভাবের সুযোগ লইয়া অনেক সাধারণ মানুষ, নারী্পুরুষ গুরু সাজিয়া বসিয়াছেন। এবং শিষ্য ইহাদের পাল্লায় পরিয়া সর্বনাশপ্রাপ্ত হন। এই প্রসঙ্গে শাস্ত্রে বলা আছে –‘শিষ্যের সন্তাপ অপহারক গুরুর সংখ্যা খুবই কম, কিন্তু বিত্ত মানে অর্থ-সম্পদ অপহারক গুরুর সংখ্যা অনেক।‘”
শ্রীবাবাজী লিখছেন –“বাবা বলিতেন, শ্রীগুরু ভগবান স্বতঃস্ফুর্তভাবে যাহা বলেন, তাহা অব্যর্থ হয়। কিন্তু গুরুদেব যখন শিষ্যদের দ্বারা চালিত হন, তখন তাহার গৃহীত সিদ্ধান্ত ভুল হইতে পারে।“
যাইহোক আবার ফিরে যাই আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগের সেই নতুনগ্রামে, যখন মাটির রাস্তা আলপথ দিয়ে হেটে যেতে হতো আশ্রমে। গ্রামের বাড়ি থেকে ভেসে আসত হস্তচালিত তাতের ঠক ঠক আওয়াজ। গ্রামের মানুষজন ভিড় করে সন্ধ্যায়-সকালে আসতেন আশ্রমে। ভোরে শিশুরা শ্রীবাবাজীর কাছে শ্রীগীতা পাঠ করতে আসতো।
সন্ধ্যায় আরতির পর বসতো শ্রীবাবাজীর পাঠচক্র আর পাঠচক্র শেষে, পুরানো মন্দিরের সামনের চাতালে সমবেত প্রসাদ গ্রহণ।
চোখ বুজলেই সব ভেসে ওঠে। শ্রীবাবাজী বসে আছেন। তার শয়নকক্ষের সামনের দাওয়ায়। ভক্তরা জড়ো হয়েছেন, তার পাঠ শুনতে। রাধামাধব ছোটাছুটি করছে হুকুম তামিল করতে। তখনকার সুকান্তবাবু (বর্তমান স্বামী সদগুরু) উদগ্রীব খাতা নিয়ে বসেছেন। এক অদ্ভুত সভা। কর্ম-ধর্ম মিলে-মিশে একাকার।
শ্রীবাবাজীকে বাতাস করছেন কেউ। একটানা।
শ্রীবাবাজী যেচে তাকে চলে যেতে বলছেন না। দেখছেন তার ধৈর্য কতো। আমি আর আমার স্ত্রী শুনছি, তার পুরাণের ব্যাখ্যা। মাঝে মাঝে বেরিয়ে যাচ্ছি বাইরে। ঘুরে এসে আবার বসছি। একদিনে আমার সেই বসে থাকার অভ্যাস তৈরি হয়নি। বেশ কয়েকবার আশ্রমে যাওয়ার পর দীর্ঘক্ষণ বাবার সামনে বসে থাকার অভ্যাস তৈরি হয়।
মনে পড়ে, পরে বাবা আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তারক বাইরে চলে যায় কেন? স্ত্রী বলেছিলেন, সিগারেট খেতে। বাবার সামনে আমার স্ত্রী কোন কথাই গোপন রাখতেন না। এটা একটা ভালো অভ্যাস। বরং, আমার গোপন করা কথা বাবা অনায়াসেই বুঝে যেতেন।
এরপর সোমবার