৭০৩ বছর পর হুগলির ত্রিবেণী মহাসঙ্গমে কুম্ভস্নান, বাংলার হারানো গৌরবের পুনরুত্থান

মানস পাল, ত্রিবেণী, ভয়েস ৯ঃ বাংলার হারিয়ে যাওয়া গৌরবের পুনরুত্থান ঘটতে চলেছে হুগলি জেলার ত্রিবেণী সঙ্গমে। ফিরে আসতে চলেছে ৭০০ বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া কুম্ভমেলা। হিন্দু-ধর্মের লক্ষ লক্ষ ভক্ত, সাধুদের আগমনের আশায় সেজে উঠছে বাঁশবেড়িয়া বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত এই ছোট্ট শহর। 
আর এই মহাকুম্ভ আয়োজনের সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়েছিল ২০২২ সালে। বাঁশবেড়িয়ার বিধায়ক তথা বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তপন দাশগুপ্তের উদ্যোগে। সেই কর্মযজ্ঞে সামিল ছিলেন ছিলেন বাশবেড়িয়া পুরসভার পুরপিতা আদিত্য নিয়োগী। সে বছর বাঁশবেড়িয়া পৌরসভা সমর্থিত ত্রিবেণী কুম্ভ পরিচালনা সমিতি কুম্ভ মেলার আয়োজন করেছিল। 
কিন্তু, এই মেলা এ বছর শুধু সাড়ম্বরে উদযাপিত হতে যাচ্ছে, তাই না, নিতে চলেছে মহাকুম্ভের আকার। এই মেলাতে সামিল হচ্ছেন ভারত তথা এই রাজ্যের বিশিষ্ট আখড়ার সাধু-সন্ন্যাসীরা। বিধায়ক তপন দাশগুপ্ত কয়েকদিন আগেই এই কুম্ভের ভূমি পূজন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। উপস্থিত ছিলেন বাঁশবেড়িয়া পৌঁরসভার চেয়ারম্যান আদিত্য নিয়োগী,সহ কাউন্সিলারগণ এবং বিভিন্ন মঠের মহারাজগণ।
আয়োজকদের আশা এবার ত্রিবেণী কুম্ভে প্রায় ৪ লক্ষ পূণ্যার্থীর আগমন ঘটবে। ইতিমধ্যেই এই মহাযজ্ঞের আয়োজনে, সারাই হয়েছে রাস্তাঘাট, সঙ্গমস্থল, গঙ্গার ঘাট। থাকছে, নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভি।আকাশ থেকে নজরদারীর জন্য থাকছে ড্রোন।
 নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন থাকছেন অসংখ্য পুলিশ-কর্মী ও সিভিক ভলান্টিয়ার। থাকছেন স্নানে সহায়তার জন্য স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ। পূণ্যার্থীদের থাকা ও খাওয়ার জন্য স্থানীয় পুরসভা বিশেষ উদ্যোগ নিতে চলেছে। সব মিলিয়ে জেলার এই শহর এখ দেশের কুম্ভ-মানচিত্রে। একসময় এ রাজ্যে, সাধু-ভক্তদের গন্তব্য বলতে ছিল সাগর-সঙ্গম, কেদুলি। এবার এই পূণ্যস্নানের মানচিত্রে যুক্ত হল ত্রিবেণী, ফিরে এল বাংলা তথা ভারতের হারানো গৌরব।
এ ব্যাপারে স্থানীয় বিধায়ক তপন দাশগুপ্ত ‘সংবাদ ভয়েস ৯’ কে জানান, “আমরা আজ গর্বিত যে, বাংলার হারানো গৌরব আমরা ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। গতবছর ছোট করে শুরু হলেও এ বছর এই ত্রিবেণী এক বিশাল সাধু-সঙ্গমের মিলন-মেলা হয়ে উঠবে। এখানে আসছেন দেশ তথা রাজ্যের বিশিষ্ট আখড়ার সাধু-সন্ন্যাসীরা। মেলায় পূণস্নানে অংশ নিতে আসছেন নাগা সন্ন্যাসীরাও। আশা করছি ৩-৪ লক্ষ মানুষের সমাগম হবে এবারের পূণস্নান উপলক্ষে। স্থানীয় মানুষ তথা পাশাপাশি জেলার মানুষদের বহুদিনের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে পেরে আমরাও গর্বিত। এবার এই মেলা ৭০৪ বছর পর হচ্ছে।“
অন্যদিকে, ত্রিবেণী কুম্ভ পরিচলোনা সমিতি সাধন মুখোপাধ্যায় জানান, ইতিমধ্যেই তারা জুনা আখাড়া, শ্রীমত স্বামী পরমাতানন্দ মহারাজ, মহানির্বাণ আখড়া সহ অনেক আখাড়াকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তারা আশা করছেন অযোধ্যা, হরিদ্বার, হৃষিকেশ সহ অনেক আশ্রম থেকে সাধুরাও এই মহাসঙ্গমে আসবেন। জানা গেছে, বিদেশ থেকেও বহু পূণ্যকামী মানুষজন এবার ত্রিবেণী সঙ্গমে পূণ্যস্নান করতে আসতে পারেন। 
ত্রিবেণী শুধু এই পূণ্যস্নানেই থেমে থাকছে না। এলাকায় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পর্যটনের প্রসার ঘটিয়ে তা বড় করে তুলতে চাইছে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজ্য সরকার। গঙ্গাঘাট ও সরস্বতী নদীর সংস্কার ও সৌন্দর্যায়নের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের পর্যটন বিভাগের সহায়তা চাওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, যমুনা, গঙ্গা ও সরস্বতী নামে তিনটি নদীর মিলন থেকে ত্রিবেণী নামটি পাওয়া যায়। আগে নাম ছিল "মুক্তবেণী", যুক্তবেণী নামেও পরিচিত ছিল। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে জেমস রেনেলের বাংলার মানচিত্রে "টেরবোনি" নামে অভিহিত করা হয়েছিল। বিখ্যাত হিন্দু দার্শনিক এলাকা "শ্মশান ঘাট"-এর পাশ দিয়ে সরু নদীখাতে প্রবাহিত হত সরস্বতী নদী যা ছিল সপ্তগ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিমে। পরে এই নদীপথ ছেড়ে গঙ্গা নদী বিশেষ করে হুগলি বা ভাগীরথী নামে পরিচিত হয়ে সমুদ্রে মিলিত হয়। ঘাটটি ভূরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের মহারাজা রুদ্রনারায়ণ রায়মুখুটি দ্বারা নির্মিত।
শোনা যায়, স্বয়ং মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব ত্রিবেণীর ঘাটে পদার্পণ করেছিলেন । ত্রিবেণীর কালীতলা নামক স্থানে সনাতন ধর্মের দেবী মা কালীর একটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে । বহুদিন অসংখ্য ভক্তগণের সমাবেশ ঘটে এই মন্দিরে । লোকমুখে শ্রুত, ঐতিহাসিক নীল বিদ্রোহে(১৮৫৯-১৮৬০) অংশগ্রহণকারী দুই ভাই রঘুনাথ সর্দার ও বিশ্বনাথ সর্দার (বিশে ডাকাত) এই বাঁশবেড়িয়া-ত্রিবেণী এলাকার বাসিন্দা ছিলেন ও তারা প্রাচীন কালীমন্দিরে ডাকাতির পূর্বে উপাসনার জন্য আসতেন ।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad