আমি আজও জানিনা ওই ভদ্রলোক কে ছিলেন, কোথায় হারিয়ে গেলেন …
তারক ঘোষ
পর্ব ২৭
বাবাজীর দেহে থাকাকালীন ও তিনি চলে যাবার পর থেকে আজও এমন কিছু ঘটনার আমি সাক্ষী, তা আমার কাছে আজও রহস্য হয়েই রয়ে গেছে। আমি জানি, তিনি সর্বক্ষণ আমাদের সকলের পাশেই আছেন, সর্বদা লক্ষ্য করছেন আমরা সঠিক পথে চলছি কিনা।
হয়ত, আমরা সবাই তাকে বা তার উপস্থিতি অনুভব করতে পারি না, কিন্তু তিনি যে তার উপস্থিতি বারে বারে জানান দিয়েছেন, আমি, আমার স্ত্রী ও মেয়ে তার সাক্ষী।
আমরা জানিনা, মৃত্যুর পর কী আছে। জীবন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয়, না কি মৃত্যু অন্য কোন জীবনের সূত্রপাত কি না। তাই অবিশ্বাস করা সম্ভব নয়। কারণ, বিজ্ঞান মৃত্যুর তীরে এসেই থমকে গেছে। বিজ্ঞানের কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই, মৃত্যুর পর ঠিক কী হয়।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান মতে, সেলুলার ডেথকেই ধরা হয় ক্লিনিক্যাল ডেথ হিসাবে। একসময়, ধরা হতো হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়াকে। পরে ব্রেনের মৃত্যু ঘটলে, মনে করা হতো, মানুষটা মৃত। এখন আর এগুলোকে মৃত্যুর লক্ষণ হিসাবে ধরা হয় না,। কারণ, হার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও হার্ট-লাং যন্ত্রের সাহায্যে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। ব্রেন ডেথ হয়ে কোমায় চলে যাওয়ার বহু বছর পরও মানুষ কোমা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছে।
কিন্তু, প্রকৃত মৃত্যু অর্থাৎ ক্লিনিক্যাল ডেথের পর কী হয়, বিজ্ঞান তা বলতে পারে না। কারণ, বিজ্ঞানের যাবতীয় তত্ব শরীর নিয়ে। কিন্তু, মানুষ বা অন্য প্রাণী তো শুধু শরীর সর্বস্ব নয়। সনাতন ধর্ম সহ খ্রীস্টান ও অন্যান্য বেশ কিছু ধর্মে ‘আত্মা’ বলে একটা বিষয় আছে।‘ আত্মা’ অর্থাৎ ‘সোল।
‘ আমি’ মানে আমার দেহ নয়, কেননা মৃত্যুর পর বলা হয়, ধরা যাক, রামবাবুর মৃতদেহ, বা জিনিয়ার মৃতদেহ, বা যদুর মৃতদেহ। এখানে, আমরাই বুঝিয়ে দিই, রামবাবু, জিনিয়া বা যদু দেহটা নয়, দেহের মালিক।
আর এই দেহের মালিকই হল আত্মা। আর এই আত্মা অবিনশ্বর, যাকে দহন করা যায় না, ছেদ করা যায় না, শুধু এক দেহ থেকে অন্য দেহে সে স্থানান্তরিত হয়। জীর্ণ পোশাক পরিবর্তনের মতো সে দেহ পরিবর্তন করে।
এই আত্মাই জীবদেহের চালিকা শক্তি।
যেমন কমপিউটার। তাকে চালাতে গেলে সফটওয়ার প্রয়োজন। কমপিউটারের সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিটের মধ্যে যতক্ষণ না সফটওয়ার ইন্সটল করেন, আপনার কমপিউটার নিছক এক মৃত যন্ত্র। আমাদের আত্মা ঠিক এইরকম এক অতি উন্নত সফটওয়ার, যেটি তৈরি করেছেন এক সুপ্রীম পাওয়ার। যিনি আমার কাছে ঈশ্বর, মহিদুলের কাছে আল্লা, রজারের কাছে গড।
কাজেই, আত্মা আছে, আছেন ঈশ্বর, আছেন আমাদের শ্রীগুরুদেব। ভিন্ন ভিন্ন রূপে তিনি আমাদের কাছে আসেন, আমরা চিনতে পারি না, বা কখনো কখনো চিনতেও পারি।
শুধু মনে রাখতে হয়, কাউকে যেন ফিরিয়ে না দিই, হয়তো তিনি এসেছিলেন পরীক্ষার ছলে, আর আমরা না চিনতে পেরে তাকেই ফিরিয়ে দিয়েছি দুঃখ দিয়ে।
বাবাজী তাই বলতেন, শত্রুর মধ্যেও ঈশ্বর আছেন, তাই শত্রুর সঙ্গেও খারাপ আচরণ করিস না, কারণ আজ তুই যা করবি, সেটা অন্যভাবে একসময় তোর কাছেই ফিরে আসবে।
তিনি বলতেন, সবের মধ্যেই লুকিয়ে আছেন তিনি, তার কথা ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না। তাই কীকরে বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে অবিশ্বাস করি!
বিজ্ঞান যেখানে শেষ হয়, সেখান থেকেই তো শুরু দর্শনের। আর আমাদের দেশের, গ্রীসের বড় বড় দার্শনিকদের আবিষ্কৃত তত্ব দিয়েই তো বিজ্ঞানের যাত্রা শুরু।
যাক, যে কথা বলছিলাম। আমি সেই মানুষটাকে সেদিনের পর আর কোথাও দেখি নি। তিনি ছিলেন আধুনিক এক মানুষ, জ্যাকেট-জিন্স পরিহিত, কিন্তু মোবাইল ব্যবহার করতেন না। তিনি যাচ্ছিলেন মুঙ্গেরে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। যাবার সময় বলে গিয়েছিলেন, আবার দেখা হবে আসামে, কোন না কোনদিন। এখনো হয়নি। তিনি আমাকে কোন ঠিকানা দিয়ে যাননি।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে চা খাওয়ার পর দাম দিতে গেলে, তিনি বলেছিলেন, ‘মনে করুন, আপনি একদিন আমার চায়ের দাম দিয়েছিলেন, আজ আমি দিই।“
ঘটনাটা খুলেই বলি। সালটা ২০০৬ এর ডিসেম্বর মাস। আমি তখন ত্রিপুরার একটা দৈনিক সংবাদপত্রের সিনিয়র পলিটিক্যাল জার্নালিস্ট। তখন, ত্রিপুরার আগরতলা পর্যন্ত রেল-যোগাযোগ শুরু হয়নি। আগরতলা যাওয়ার তিনটি রুট। বাসযোগে গুয়াহাটি থেকে শিলং হয়ে আগরতলা, বিমানে সরাসরি দমদম থেকে আগরতলা অথবা বাসে বাংলাদেশের ঢাকা হয়ে আগরতলা। বিমান আর এটাই সর্টেস্ট রুত। কিন্তু বাংলাদেশ হয়ে যেতে গেলে পাসপোর্ট লাগত।
আর বাসে গুয়াহাটি থেকে আগরতলা প্রায় ২৪ ঘন্টার যাত্রা।
তার একটা কারণ ছিল, সন্ত্রাসবাদী হামলার জন্য সমস্ত গাড়িকে কুমারঘাট থেকে অনেকটা পথ এস্কর্ট এ যেতে হতো। যাইহোক, সেবার বাসেই ফিরছি আগরতলা থেকে গুয়াহাটি। এর আগে আর একটি ঘটনা ঘটেছিল। একবার আসার সময় আমাদের বাসে হামলা হয়।
শিলিগুড়ি থেকে গুয়াহাটি হয়ে আগরতলা আসছিলাম। আমাদের বাস তখন গনেশগুঁড়ির কাছে। আচমকাই এক যাত্রী আমার সীটে বসতে চাইলেন। আমি নিছক নিমরাজী হলাম। স্থান বদল করে আমি বাসের বাম দিকে তার আসনে বসলাম। আর উনি বসলেন বাসের ডান দিকে আমার ছেড়ে যাওয়া আসনে। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর বাস লক্ষ্য করে ছুটে এল বোমা জাতীয় কিছু। লাগলো না, দূরে গিয়ে ফাটলো।
অন্ধকার রাস্তার পাশে জ্বলে উঠলো আগুন।
পেশায় সাংবাদিক, এরকম বহু ঘটনার সাক্ষী আম, তাইি ভয় পাইনি, শুধু উঠে গিয়ে ড্রাইভারকে গিয়ে বললাম, গাড়ি থামাবেন না। ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম, বিরাট পাথর জাতীয় কিছু এসে আমি আগে যে সিটে বসেছিলাম, তার কাচে লাগলো। একেবারে তীব্রবেগে ওই ভদ্রলোকের মাথায়। উনি গড়িয়ে পড়লেন সিটে। মাথা থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে। বাস তখন দুরন্ত গতিতে ছুটছে। মাঝে মাঝে বোমার আওয়াজ।
কয়েকজন ওই ভদ্রলোককে ধরে মাথায় ব্যান্ডেজ করতে লাগলেন। তিনি তখন অচেতন। অথচ, ওই ঘটনা আমার উপর ঘটা উচিত ছিল, কেননা ওই আসনটাই শিলিগুড়ি থেকে আমার নামেই বুক করা, উনি এসে আসন না বদলালে, আমার মাথা থেকেই তখন রক্ত ঝরতো।
বাস এসে ঢুকলো থানায়। ওই অচেতন ব্যক্তিকে পুলিস নিয়ে চলে গেলেন হাসপাতালে।
পুলিশকে ড্রাইভার যা জানানোর জানালেন। কিছুক্ষণ পর আবার বাস ছাড়লো গন্তব্যের দিকে। থানায় শুনেছিলাম, ওই ভদ্রলোক একাই যাচ্ছিলেন। শিলং যাবার কথা।
একটু পরেই আমার স্ত্রীর ফোন তারকেশ্বর থেকে, আমাকে ফোনে জানালেন টিভিতে বলেছে, গনেশগুঁড়িতে ব্যাপক ঝামেলা হচ্ছে। আমি ওকে শুধু বললাম, জানি। কিন্তু, সেদিন যা জানলাম, তা হলো তিনি এসেছিলেন। বাবা তখন আশ্রমে। আর আমি আসামে।
কিন্তু, যে কথা বলছিলাম। সেবার আগরতলা থেকে টিকিট কাটলাম, একেবারে হাওড়া। আগরতলা থেকেই ট্রেনের আসন বুক করা যেত। আসন বুক করে বাসে রওনা দিলাম গুয়াহাটির পথে। বাস ছাড়লো বেলা বারোটা হবে। গুয়াহাটি পৌঁছাবে পরের দিন সাড়ে এগারোটা নাগাদ। আমার অসম্ভব ভালো লাগে এই পথ। সড়কপথে গুয়াহাটি, শিলং হয়ে।
সত্যি বলতে কি, পাঁচমুড়া, সোনাচূড়া আর আমবাসার সেই পার্বত্যপথকে আজও ভুলতে পারিনি । আকাশ ছুঁয়ে থাকা পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সেই ঘুর্ণায়মান পথ । খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা শাল-সেগুনের মৌনতা, পাহাড়ের মাথায় ভারতীয় সেনাদের অতন্দ্র প্রহরা । পাহাড়ের কোলে আদিবাসী গ্রাম, রাতের গভীরে সেখানে উগ্রপন্থীদের পদধ্বনি । আমার মনকে ছুঁয়ে যায় সেই গ্রাম । মনের গভীরে একটা দলা পাকানো কষ্ট অনুভব করি বিপথগামী সেই মানুষগুলোর জন্য।
আগামিকাল