শূন্য হাতে এসেছিলেন, সব বিলিয়ে আবার শূন্য হাতেই চলে গেছেন। রেখে গেছেন, এমন এক জীবন, যা অনুসরণ করে চললে, সাধু সমাজের তো বটেই, গৃহী মানুষরাও বুঝতে পারবেন জীবনের প্রকৃত অর্থ।
তারক ঘোষ
একটা মহাজীবন কেমন হওয়া উচিত, বাবাজী মহারাজ তার গুরুদেব সম্পর্কে বলতে গিয়ে বারে বারে সে কথা বলেছেন। কেননা, শ্রীজানকীদাসজী মহারাজ ছিলেন, এক প্রকৃত সন্ন্যাসী, যার জীবনে শ্রীভগবান বারে বারে এসেছেন পরীক্ষকের ছদ্মবেশে।
আর দাদাজী মহারাজ সেই পরীক্ষায় বারেবারে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। আর অদ্ভুতভাবে আমরা দেখেছি বাবাজী মহাজকেও সেই একইভাবে বারবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে। শ্রীজানকীদাসজী ও শ্রীপ্রজ্ঞাদাসজী দুজনকেই আগুনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, যে আগুন তাদের খাঁটি সোনায় পরিণত করেছে।
বাবাজী মহারাজ লিখছেন – ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার সময় বাবাজী মহারাজের পোষাকের কোন চাকচিক্য ছিল না।
একদিন, ইউনিভার্সিটির দারোয়ানরা বাবাজীকে বলছিলেন, ‘আপনি আপনার বই এর ব্যাগের উপর স্টুডেন্ট কথাটা লিখে রাখবেন, না হলে প্রায়ই আপনাকে দারোয়ান ভেবে ভুল করি।'
কিন্তু, বাবাজী মহারাজ অসম্ভব ভাল ইংরাজী বলতেন। ইংরাজী ভাষায় অনর্গল কথা বলার ক্ষমতা ছিল তার। আর স্বভাবতইঃ ইংরাজী জানার জন্য সবাই তাকে সমীহ করতেন। আর ছাত্র হিসাবে তিনি শিক্ষক ও সহপাঠীদের অতিশয় প্রিয় ছিলেন।
এবার যদি আমরা ফিরে যাই, আর এক মহামানবের কলেজ-ইউনিভার্সিটি জীবনে। দেখতে পাব, কেন তিনি শ্রীজানকীদাসজীর প্রিয় ছিলেন।
আপনারা সকলেই জানেন, রাজ্যে সেসময় ছিল বামপন্থী শাসন। ধর্ম সম্পর্কে এই সরকারের কোন মাথাব্যথা ছিল না। আজ উত্তরপ্রদেশে, বা বিজেপি শাসিত রাজ্যে ধর্ম যেভাবে গুরুত্ব পায়, এই রাজ্যে ধর্মের আলাদা কোন গুরুত্ব ছিল না। সালটা হবে ১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ এর মধ্যে।
বাবাজী মহারাজ মাথার চুল কাটাতেন ছোট ছোট করে, অনেকটা কদমছাঁট। আর রাখতেন শিখা, যাকে টিকি বলা হয়। পরনে একটা কমদামী কাপড়, গায়ে ফতুয়া। কপালে তিলক। আর কাঁধে ফেলে রাখতেন একটা চাদর। ৯০ এর দশকে এই দৃশ্যটা একেবারেই বিরল।
শ্রীদাদাজীর সময়ে, তার পোশাকের জন্য, যেমন তাকে হাসির খোরাক বানানো হয়েছিল, বাবাজীর ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই।
সতগুরুদাসজীর লেখা বাবাজীর জীবনচরিত থেকে জানতে পারি –বাবাজী ক্লাসে বসলে, তার ঠিক পিছনের বেঞ্চের ছেলেরা তার টিকিতে ফুঁ দিত, কপালে তিলক দেখে কেউ কেউ বলত – কিরে, তোর কপালে কাকে পায়খানা করে দিয়েছে নাকি? বাবাজী মহারাজ সমস্ত কিছু সহ্য করেছেন শান্তভাবে। ঠিক যেমন করে গিয়েছিলেন স্বামী শ্রীজানকীদাসজী।
আর একটা অদ্ভুত মিল দেখতে পাই। শ্রীজানকীদাসজীর গুরুদেব তার জন্য একটা মোটা সূতির বিছানার চাদর পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন, প্রয়োজনে ওটাতে সবুজ রঙ করে নিতে। দাদাজী মহারাজ পরম শ্রদ্ধায় সেই চাদরটি সবুজ রঙ করে নিয়েছিলেন, আর ওটা গায়ে দিয়েই ইউনিভার্সিটিতে যেতেন।
আবার যদি বাবাজী মহারাজের ক্ষেত্রে দেখি, দেখতে পাই –
বর্ধমান রাজ কলেজ। বাবাজী মহারাজ এখান থেকেই স্নাতক হন
শ্রীজানকীদাসজী বলছেন –ওকে একটা কম্বল কেটে কোট বানিয়ে দে। আসলে, শীতকালে ইউনিভার্সিটি যেতে বাবাজী মহারাজের শীত করত, তাই তার গুরুদেবকে একটা সোয়েটারের কথা বলেছিলেন।
যাই হোক, কম্বল কেটে কোট হল।
বাবাজী মহারাজ সেই কোট গায়ে ইউনিভার্সিটি গেলেন। যথারীতি তিনি হয়ে উঠলেন ছাত্র-সমাজের কাছে হাসির খোরাক। ছেলেরা তাকে জিজ্ঞাসা করল, কিরে, এই বিদঘুটে ব্লাউজ পরে এসেছিস কেন?
বাবাজী মহারাজ দাদাজী মহারাজকে সেই কথা না বলে, বলেছিলেন, ঝুলটা একটু কম হয়েছে। শ্রীজানকীদাসজী তখন অন্যদের বললেন, আর একটু কম্বলের টুকরো সেই কোটের নীচের দিকে জুড়ে দিতে। তাই করা হল।
অন্য রঙ এর কম্বলের একটা টুকরো জোড়া হল তার সঙ্গে। হয়ে উঠল আরো বিদঘুটে। অথচ, সেটাকেই গুরুর আশীর্বাদ হিসাবে পরে যেতেন তিনি।
শ্রীজানকীদাসজী নিজের জন্য খরচ করতেন খুব ভেবে। তিনি বলতেন – গৃহস্থরা রক্ত জল করা পয়সা পাঠায়। সেটা অপ্রয়োজনে খরচ করলে ভগবান অপ্রসন্ন হবেন। এক একটা সময়, একটা কাপড় বা গামছা ছিঁড়ে ব্যবহার করতেন। আর তা ব্যবহারের সম্পূর্ণ অযোগ্য না হওয়া পর্যন্ত ত্যাগ করতেন না। একটা মাত্র কাঁচকলা, ভক্তের দেওয়া একটা আপেল খেয়ে তার দিন কেটেছে। কোন কোন দিন মাত্র দু চামচ প্রসাদ পেতেন।
তিনি ছিলেন সন্ন্যাস এর প্রকৃত উদাহরণ। আর আজ যখন দেখি, এক শ্রেণির সাধু-সন্ন্যাসীরা বিলাসিতার বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন, ট্রেনের পরিবর্তে বিমানে যাতায়াত করছেন (জরুরী না হওয়া সত্বেও), তখন মনে পড়ে ওই সমস্ত সাধকদের কথা, যাদের জীবনই ছিল তাদের বাণী।
কিন্তু, যুগ বদলেছে, কৃষ্ণ ভজনার মধ্যেও ঢুকে পড়েছে আধুনিকতা। ডিজে বাজিয়ে উদ্দাম নৃত্যের সঙ্গে ঈশ্বর ভজনা হচ্ছে। তখন, মনে হয়, কে ঠকলেন? বা কে ঠকছেন?
বাবাজী লিখছেন – বাবাজী মহারাজ কোন জায়গায় ভ্রমনে গেলে ধনী শিষ্য অপেক্ষা গরীবের পর্ণকুটিরকেই বেশি অগ্রাধিকার দিতেন। কোন শিষ্য বিলাসদ্রব্য দিলে, তিনি তা ব্যবহার করতেন না। আধুনিক সমাজে বাস করেও তিনি লোক শিক্ষার্থে সহজলোভ্য সুখকে বর্জন করে নির্লিপ্ততার মধ্যে সাধুতাকে রক্ষা করে গেছেন। আমদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য।
বাবাজী মহারাজও আমাদের সেই লোকশিক্ষা দিয়ে গেছেন। সাধুর জীবন কেমন হবে, কেমনভাবে গৃহস্থরা জীবন যাপন করলে তাদের দুঃখ আসবে না, সব বলে গেছেন। বিলাসিতার কাছ দিয়েও হাঁটেন নি। ভক্তদের দান করা অর্থে ভক্তদের জন্যই মন্দির করেছেন, তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন।
শূন্য হাতে এসেছিলেন, সব বিলিয়ে আবার শূন্য হাতেই চলে গেছেন। রেখে গেছেন, এমন এক জীবন, যা অনুসরণ করে চললে, সাধু সমাজের তো বটেই, গৃহী মানুষরাও বুঝতে পারবেন -
“সকলের তরে সকলে আমরা,
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।“