‘আমার সাধনা, শিক্ষাকে মানুষের মধ্যে ভাগ করে একটা সুস্থ সমাজ গড়তে চাই। হানাহানি, হিংসাকে বন্ধ করতে চাই। চাই লোভ সংবরণ করতে। কতটা পেরেছি, তা নিয়ে সংশয় তো আছেই।"
শ্রীশ্রী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া
পার্থিব দেহ ছাড়ার বছর তিনেক আগে থেকেই বাবাজী মহারাজের মধ্যে একটা পরিবর্তন অনেকেই লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু, কেন বাবাজী মহারাজকে চিন্তাশীল লাগত, কেন তিনি আর আশ্রমে থাকতে চাইতেন না, আমরা এ সবের সঠিক উত্তর জানি না। কিন্তু, মাঝে মাঝেই তার কন্ঠ থেকে ঝরে পড়ত বেশ কয়েকটি কথা – ‘’বুঝলি, সাধু হওয়া ভালো নয়’, ‘সাধুদের অনেক জ্বালা’, ‘বিষ্ণুদাসের দিকে দেখ, ও অনেক এগিয়ে আছে’, ‘সময়টা খারাপ’ – এইধরণের কথা তিনি বহুবার ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বলেছেন। ফোনে, আশ্রমে বসে।
আমরা এর কারণ খুঁজিনি, শুধু নিজের স্বার্থ নিয়েই ছুটে গেছি আশ্রমে, তারপর স্বার্থ ফুরালে, কেটে পড়েছি।
একেবারে প্রথম দিকে বাবাজী মহারাজ মজা করেই বলতেন – আমি বকাউল্লা, বকবক করে যাচ্ছি, তোরা শোনাউল্লা, শুনে যাচ্ছিস, করিমউল্লা কেউ নেই। তার এই কথাগুলোই পরে আক্ষেপের সুরে ধ্বনিত হতো।
কারণ, তিনি ছিলেন সেই মহাপুরুষ, যিনি অন্যের আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উন্নতির জন্যই ধরায় এসেছিলেন, নিজের স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য নয়।
আমি লক্ষ্য করেছি, যখন আমি এই প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলি, তখন অনেকেই অখুশী হন, কেউ কেউ প্রতিবাদও করেন, যুক্তিহীন, অসার প্রতিবাদ। কেউ কেউ, নানাভাবে আমাকে ‘কিছু একটা’ বলতে চেষ্টা করেন। যাইহোক, সেসব, সাংবাদিকদের কাছে ‘প্রফেশনাল হ্যাজার্ডস’।
অনেক কথাই তো লেখা যায় না, তাই লিখতে পারিনি।
মাঝে মাঝে মনে পড়ে তরুণবাবুর কথা। আশ্রমে পুরানো মন্দিরের সামনে একটা বাড়ির দোতলায় থাকতেন। কারো সাতে-পাঁচে থাকতেন না। নিজের জীবনের অন্তহীন কষ্টকে বুকে চেপে কাটিয়ে দিয়ে গেলেন জীবনের শেষ দিনগুলো।
মনে পড়ে পিসিমার কথা, উনিও অনেক কষ্ট নিয়ে আশ্রম ছেড়ে ফিরে গেলেন আসামে। সাক্ষাৎকারে আসামের বহু মানুষ আমাকে অনেক কথাই বলেছিলেন, পিসিমাও বলেছিলেন।
একবার গুজরাত থেকে এক মহিলা ফোন করলেন। তিনি রাগের সপ্তম সুরে উঠে বলে উঠলেন – ‘ওই তরুণবাবু অনেক কিছু জানেন।‘
তরুণবাবু কী জানেন, ওনার রাগের কারণ কী- বুঝলাম না। আজ তরুণবাবু আর আমাদের মধ্যে নেই, তাই কথাগুলো বললাম।
তরুণবাবু বাবাজী মহারাজকে নিয়ে কিছু লিখছিলেন শুনেছিলাম।
বাবাজীর প্রবচনের সময়, তিনি ধীরে ধীরে এসে একটা চেয়ারে বসতেন। তারপর প্রসাদ নিয়ে ফিরে যেতেন তার দোতলার ঘরে। উনি ছিলেন নিপাট ভালো মানুষ। ওনার সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার কথা হয় আশ্রমে। নিজের জীবনের কোন কথা তিনি বলতেন না।
বাবাজী মহারাজ ছিলেন তার গুরুভ্রাতা। কিন্তু, তার প্রতি তরুণবাবুর শ্রদ্ধা ছিল অগাধ। তবে, একটি কথা মাঝে মাঝে বলতেন। বাবাজী মহারাজ চলে যাওয়ার পর খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধার কথা নিয়ে তিনি অনেকবার অভিযোগ করেছেন। বাবাজী চলে যাওয়ার পর, পিসিমাও এই অভিযোগ করেছেন, তরুণবাবুও করেছেন। কিন্তু, পিসিমা ও তরুণবাবু ছিলেন নিপাট ভালোমানুষ।
কিন্তু, আজও জানতে পারিনি, তিনি বাবাজীকে নিয়ে কী লিখছিলেন। হয়তো, ওনার সব লেখাই হারিয়ে গেছে। আর সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে অনেক স্মৃতি। ওনার আত্মার শান্তি কামনা করি। মনে পড়ে বিষ্ণুদাসজীর কথা।
আর এক শান্ত, মধুর স্বভাবের সন্ন্যাসী। যার কোনদিন কোন লোভ ছিল না। তার কাছে পড়ে থাকতো ভক্তদের দেওয়া প্রণামী, তিনি কোনদিন গুনেও দেখেন নি। এই বিষ্ণুদাসজী তথা বিহারী।
প্রয়াত শিশির কুমার ঘোষালের গ্রন্থ থেকে জানতে পারা যায় – ‘রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শম্ভু ভাস্করের পুত্র তপন সূত্রধরের শ্যালক বিহারী।‘
বাবাজী মহারাজকে দেখার পর, বিহারীর মনে বিরাট পরিবর্তন আসে। আজন্ম সন্ন্যাসী এই মানুষটা শুধু কর্তব্যের দাস হয়েই ছিলেন। তার মনের একটা দিক তার কর্তব্যে, আর একটা দিক খুঁজছে বাবাজীর শ্রীচরণ। সংসারে ভয়ানক দারিদ্র, কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
বাবাজী তাকে একদিন বললেন –‘বাবা-ভাইকে যিনি এই সংসারে এনেছেন, তিনিই তাদের দেখবেন।‘
এই বিহারীই বাবাজী মহারাজের প্রথম সাধু শিষ্য শ্রী বিষ্ণুদাস কাঠিয়া। তার মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম এক সাধককে, যিনি শারীরিক কষ্টের উর্ধে উঠেও সাধন ভজন করে গেছেন সমর্পিত চিত্তে। আজ তার কথা মনে পড়ে। এই বিহারীর পূর্বাশ্রমের ভাই হলেন রুহিতোষ। একেও বাবাজী মহারাজ তার চরণে স্থান দিয়েছিলেন।
পরে, এই রুহিতোষ বাবাজীর কাছে সন্ন্যাস নেন, নতুন নাম হয় শ্রীরাধামাধব দাস কাঠিয়া।
আর একজনকে মনে পড়ে – সুকান্ত বাগচি। ‘অর্ঘ্য’ পত্রিকায় তার ‘কাঁচা-পাকা’ নামে একটা লেখা পড়তাম। বহু বছর পর, তিনিও সন্ন্যাস নেন। নাম হয় শ্রী সদগুরু দাস কাঠিয়া।
আর সেরকম কোন মুখ মনে পড়ে না, যাকে নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সেইসময়, বাবাজীর পাশে অনেক চেনা-অচেনা মুখ দেখেছি, আজ তাদের অনেকেই নেই।
যাইহোক, সেসব কথা যাক। বাবাজী মহারাজ চাইতেন, ভগবানের কথা কানে শুনে চলে যাওয়া নয়, নিজের জীবনে সেই আদর্শ পালন করা।
সংসার জীবনে কীভাবে, ভাল থাকা যায়, বাবা বারবার নানা উপমা, নানা গল্পের মাধ্যমে, সেই কথা বলে গেছেন। অনেকেই শুনতেন, তারপর যাকে তাই। আবার ভুলে লিপ্ত হয়ে পড়তেন, সেই ‘অকর্মে,’ যেগুলো বাবাজী মহারাজ এড়িয়ে যাবার কথা বারবার বলতেন।
আমাকে একজন বলেছিলেন – গুরুদেব না থাকলেও গুরুর আশ্রমে যেতে হয়।
আমি সেইমুহুর্তে তার কথার প্রতিবাদ না করে সায় দিয়েছিলেম, কারণ, তিনি যাতে আমার কথায় অন্য কিছু না মনে করেন।
আজ বলি, শ্রীগুরুর স্থান হৃদয় মন্দিরে- আশ্রমে নয়। যিনি, শ্রীগুরুকে ভালোবেসে তাকে মনের গভীরে স্থান দিয়ে নিত্য তার নাম জপ করে চলেছেন, তাকে আর কোথাও যেতে হবে না। আর আশ্রমে গেলে অযথা মন খারাপ হয়ে যাবে, কারণ প্রতি মুহুর্তে তুলনা আসবে, তখন ও এখনের।
বাবাজী দোষ দেখতে নিষেধ করেছেন। ব্যক্তি আমিও তা দেখিনা, কিন্তু, আমার সাংবাদিক সত্তা দেখে – অন্যের দোষ দেখে, কারণ ওটাই আমার কর্ম। আর বাবাজী বলেছেন, যার যার কর্ম সততার সঙ্গে করে যেতে।
তাই তিনি আক্ষেপের সুরেই বলতেন – শোনাউল্লা সবাই, করিমউল্লা কেউ নেই। সাংবাদিকদের সঙ্গে শ্রীবাবাজীর সাক্ষাৎকারের একটি অংশ দিয়ে শেষ করি।
‘আমার সাধনা, শিক্ষাকে মানুষের মধ্যে ভাগ করে একটা সুস্থ সমাজ গড়তে চাই। হানাহানি, হিংসাকে বন্ধ করতে চাই। চাই লোভ সংবরণ করতে। কতটা পেরেছি, তা নিয়ে সংশয় তো আছেই।'