ধারাবাহিক উপন্যাসঃ 'কারো ছায়া নেই' আদিবাসী জীবন, ডাইন, মহাজনী প্রথা, অরণ্যের অধিকার নিয়ে অন্য এক উপন্যাস ১

'সিধু-কানু'দের লড়াই আজও থামে নি।
আমার গুরুদেব ড: শ্রীশ্রী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া ও বিশিষ্ট লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর অমর স্মৃতির উদ্দেশ্যে

 এই উপন্যাস রচনার একটা প্রেক্ষাপট আছে। আমি তখন একটি সর্বভারতীয় ইংরাজী পত্রিকার সাংবাদিক। সালটা বোধহয় ১৯৯৬ হবে। আমাদের নিউজ এডিটর আমাকে পাঠান প্রখ্যত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য। 
আমি তো এই অ্যাসাইনমেন্ট পেয়ে ভীষণ পুলকিত। ‘অরণ্যের অধিকার’ ‘হাজার চুরাশীর মা’ কে যে সামনা-সামনি দেখতে পাব, কথা বলতে পারব, এটা একটা বিরাট ব্যাপার। কেননা, মহাশ্বেতা দেবী আমার স্বপ্নের লেখিকা। 
যাইহোক, আমি তার বাড়ি গেলাম। উনি আমায় শুধু সাক্ষাৎকারই দিলেন না, খেরিয়া শবরদের নিয়ে কিছু লেখার জন্যও বললেন। ওদের জীবন, জীবনের লড়াই, সুখ-দুঃখ সব কিছু নিয়ে। আমি তো তার কথায় ভীষণ লজ্জা পেলাম। যিনি তার জীবনের একটা বিরাট অংশ এই আদিবাসী সমাজের জন্য ব্যয় করেছেন, তিনি আমার মতো একজন তুচ্ছ সাংবাদিককে বলছেন তাদের নিয়ে লেখার কথা। 

উনি আমাকে বললেন, আমি ইচ্ছা করলে ওনার সঙ্গে পুরুলিয়ার রাজনগর সহ আশ-পাশের আদিবাসী এলাকায় ঘুরতে পারি। সেদিন থেকে আমি আদিবাসী জীবনকে দেখেছিলাম আমার শ্রেষ্ঠ লেখিকার চোখ দিয়ে। সাংবাদিক হিসাবে সেদিন আমি লিখেছিলাম অনেক কিছু। 
কিন্তু, সেখানে অনেক কিছুই লেখা যায় না। আজ তার মৃত্যুর বহু বছর পর আমি হাত দিলাম অন্য এক উপন্যাস রচনায়। আর তা বাংলা ভাষাতেই। আপনারা সকলেই জানেন, মহাশ্বেতা দেবী ইংরাজী ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। অথচ, তিনি লিখেছেন বাংলাতেই। 

উপন্যাসটি সম্পর্কে দু-এক কথা

 ছোটনাগপুর মালভূমির আদিবাসী অধ্যুষিত রুক্ষ প্রান্তরে সবুজের আচ্ছাদন দিতে চেয়েছিলেন এক দেহাতি অশিক্ষিত মানুষ। শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভের পর সন্ন্যাস জীবন বেছে নেওয়া আর একজন এসেছিলেন মানুষের রুক্ষ-সুক্ষ-মরুপ্রায় মনোভূমিতে ভালোবাসার সজল ধারা বইয়ে দেওয়ার জন্য। ডাইন-প্রথা, জানগুরুদের মাঝে নিদারুণ দারিদ্র্য, কর্মহীনতা, মহাজনদের নিষ্পেষনে কেমন আছে ভূমিপুত্র আর ভূমিকন্যারা? 
এক অসমাপ্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দক্ষিন-পূর্ব রেলের এক শুনশান স্টেশনে বদলি নিয়ে এলেন সূপর্ণ। আর তারপর… 
জীবনের নানা অধ্যায় আর রুক্ষ মাটির বুকে এ এক অন্য রূপকথা, যে রূপকথায় মৃত্যুর ছায়া পড়ে, কিন্তু জীবনের প্রান্তরে কারো ছায়া নেই। 

 অধ্যায় ১ 

দিনের শেষ প্যাসেঞ্জার ট্রেনের শেষ কামরাটা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গেলেও সেদিকে হুঁশ ছিল না সূপর্ণের। তখনও তার হাতে ধরা সবুজ সিগন্যাল ফ্লাগটা বেলাশেষের গরম হাওয়ায় আন্দোলিত হয়ে চলেছে। ট্রেন তখন অনেকটা দূরে। ডিসট্যান্ট সিগন্যাল ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে মজে যাওয়া কাজরী নদীর উপর পুরানো সেতুর দিকে। দূর থেকে ট্রেনের হুইশেলটা তার কানে ঢুকতেই, সম্বিত ফেরে সূপর্ণের। তাকিয়ে দেখে দূরের ছোট ব্রিজটা পার হয়ে ট্রেনটা হারিয়ে যাচ্ছে বাকের আড়ালে। ট্রেনের গার্ডও ঢুকে গেছেন তার বসার জায়গায়। 
সেদিনের মতো, এটাই শেষ যাত্রীবাহী ট্রেন। আসে টাটানগর থেকে, চলে যায় তার গন্তব্য পুরুলিয়ায়। এটাই প্রতিদিনের দৃশ্য। আর খুব একটা অচেনা কেউ নামে না এই শেষ ট্রেন থেকে। যারা নামে সূপর্ণ কম-বেশি সবাইকেই চেনে। এদের মধ্যে আছেন গোঁসাইবাবা আর সাধু। ভোরের ট্রেনে এরা চলে যায় টাটানগরের গাড়ি ধরে আর ফিরে আসে এই ট্রেনে। 
মাস ছয়েক আগে এই স্টেশনে কাজে যোগ দেওয়া থেকে এই চেনা ছবিটাই প্রতিদিন দেখে আসছে সে। সে ছবির খুব একটা বদল হয়নি এই ছ’মাসে।
দূরের আধো-অন্ধকার থেকে চোখ সরিয়ে লাল কাঁকড় বিছানো প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে সে। এরপর সন্ধ্যা থেকে সারা রাত শুধু মালগাড়ির যাওয়া আসা। এই প্ল্যাটফর্মে তাদের থামার কথা নয়। সচরাচর থামেও না। কিন্তু, তাই বলে সূপর্ণের কাজ ফুরোয় না। বরং এই সময়ে তার কাজ আরো বেড়ে যায়। টাটানগর আর পুরুলিয়ার দিক থেকে আসা মালগাড়িগুলোকে ঘুরিয়ে দিতে হয় ইস্পাত ফ্যাক্টরীর দিকে। টাটানগর থেকে কখনো খালি গাড়ি আসে, কখনো বা ভর্তি। আবার একইভাবে পুরুলিয়ার দিক থেকেও খালি ও ভর্তি মালগাড়ি আসে।

 স্টেশন থেক একটু দূরেই দু দিকে দুটো শাখা লাইন চলে গেছে। একটা গেছে ইস্পাত ফ্যাক্টরীর দিকে আর অন্যটা অভ্র কারখানার দিকে। এই মালগাড়িগুলোকে শাখা লাইনে পাঠানোই মূল কাজ কেবিনম্যান সূপর্ণ রায়ের। রেলেই কেটেছে তার জীবনের দীর্ঘ ২০ বছর। মাত্র তেইশ বছর বয়সে কাজ যোগ দিয়েছিল সে। আর তার বয়স এখন বিয়াল্লিশ।
 আস্তে আস্তে অন্ধকার নামছে। টাটানগরের দিক থেকে মালগাড়ি আসতে এখনো ঘন্টা দুয়েক দেরি। জংশন স্টেশন থেকে এই সময় কোন ফোনও আসে না। তাই কিছুটা সময় তার নিজের জন্য সে ব্যয় করতে পারে। স্টেশনমাস্টারের ছোট ঘরটা পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখে স্টেশনমাস্টার অনিমেষবাবু একমনে খাতা সারছেন। একটু দূরেই টুলের উপর বসে আছে সিতাই। ওর কাজ টিকিটবাবুর। যাত্রীদের টিকিট বেচা। আর কাজ শেষ হলেই স্টেশন মাস্টারের ঘরে ঢুকে টুলটার উপর বসে থাকা। সূপর্ণ জানে, এর পিছনে সিতাই এর কোন না কোন উদ্দেশ্য থাকে। 
একটু মৃদু হেসে ও এগিয়ে যায় লিকলিকে একটা পলাশ গাছের নীচে রাখা যাত্রীদের বসার একটা বেঞ্চের দিকে। স্টেশনে একটা প্ল্যাটফর্ম। সিঙ্গল লাইন হলেও এই স্টেশনে ক্রসিং করানোর কোন ব্যবস্থা নেই। আছে টাটানগরের দিকে এর পরের স্টেশনে। তাই একটা প্ল্যাটফর্মই যথেষ্ট। সূপর্ণ এসে দাঁড়ায় নির্দিষ্ট বেঞ্চটার কাছে। জনাচারেক লোকের মতো জায়গা। কাঠের সরু সরু ফালি জুড়ে তৈরি বেঞ্চ। মোট ১০ টা ফালি। ভালোভাবেই বসা যেত, কিন্তু এখন সেখান থেকে ৪ টে ফালি অদৃশ্য, ফলে বসতে গেলে একটু সাবধানেই বসতে হয়। 
রেলদপ্তরের অবশ্য এসব নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। তাই এই স্টেশন স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। আধুনিকতার কোন চিহ্ন প্রায় নেই। পুরানো বিল্ডিং। রঙ কবেই মুছে গেছে। প্ল্যাটফর্মের দু দিকে স্টেশনের নাম লেখা বোর্ডগুলোর অবস্থাও বেশ করুণ। যারা স্টেশনের নামটা জানেন, তারা বাংলা, উর্দু আর ইংরাজীতে লেখা নামটা পড়তে পারবেন। আর নতুন যাত্রী হলে, তিনি বোর্ড দেখে বুঝতেই পারবেন না, কোন স্টেশনে এসে নামলেন। ভরসা একমাত্র ছোট্ট লাল রঙের বিল্ডিং এর মাথায় লেখা নামটা – ঝাপসা হয়ে গেলেও বোঝা যায়- স্টেশনের নাম পলাশতলী। 
নামটা শুনলেই মনে হতেই পারে, রুক্ষ লাল মাটির বুকে পলাশের জঙ্গলে ছাওয়া এই স্টেশন - পলাশতলী। নাঃ একসময় হয়তো ছিল পলাশের আগুন, ছিল পলাশের ডালে বসন্তের বন্যা। রাতের গভীরে পলাশের নীরব গন্ধ। আজ সব স্মৃতি। জঙ্গল মুছে শুধু মাথা তুলেছে কারখানার চিমনি। ধুলো আর ধোয়ায় পলাশের স্মৃতিও ধূসর। পুরুলিয়া-টাটানগর সেকশনে ছোট্ট একটা স্টেশন এই পলাশতলী। বেশ কাব্যিক নাম। বদলী হওয়ার আগে স্টেশনের নামটা শুনেই স্টেশনটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সূপর্ণ। বদলীর কাগজ নিয়ে বাড়িতে ফিরেই স্ত্রী মিলিকে শুনিয়েছিলেন স্টেশনের নাম। 
মিলি নামটা শুনে খুশি হলেও, যখন জানলেন, সারাদিনে ওই স্টেশন দিয়ে মাত্র তিনজোড়া প্যাসেঞ্জার ট্রেন যায়, তখন বেশ চমকে উঠেছিলেন। দীর্ঘ ১৮ বছর সূপর্ণের সঙ্গে ঘর করার সুবাদে বার ছয়েক নানা জায়গায়, নানা স্টেশনে বদলি হওয়ার অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। তবে সবকটি স্টেশনই ছিল শহর এলাকায়। কিন্তু, এবারই ব্যতিক্রম। মালভূমি অঞ্চলের রুক্ষ মাটির উপর একটা ছোট্ট স্টেশন। শহর বলতে মাইল আষ্টেক দূরে। তাই এবারে আর মিলি তার সঙ্গে আসতে চায় নি। তবে, শুনশান এলাকা বলে নয়। মেয়ে সৈকতা ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। স্কুল, টুইশান – এসব ছেড়ে নির্বাসনে গেলে ভবিষ্যতটাই তো অন্ধকার হয়ে যাবে। তাছাড়া সামনের বছর হায়ার সেকেন্ডারী। জাবো বললেই যাওয়া যায় না। সূপর্ণও বোঝে, বদলি মানেই সঙ্গে সঙ্গে একটা সংসার গুছিয়ে নিয়ে অন্য জায়গায় গিয়ে বসিয়ে দিলাম, এটা এখন আর হয় না। ছেলে-মেয়ে পড়াশোনার জগতে প্রবেশ করে একটু উঁচু ক্লাসে উঠলে, তখন বদলি যে কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে যায়, সেটা ভূক্তভোগী মানুষই জানেন। মেয়ে অবশ্য বলেই রেখেছিল, সামার ভ্যাকেশনে সে বাবার কাছেই পলাশতলী যাচ্ছে। 
পুজোর পড়েই বদলি হয়ে পলাশতলীতে এসেছে সূপর্ণ। তারপর মাঝে বার তিনেক কলকাতার সল্ট-লেকে তাদের বাড়িতে গিয়েছিল। দিন তিনেক ছিল। দুদিন কাটতেই মনটা পলাশতলীতে ফেরার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠেছিল। কলকাতার সেই প্রাণবন্ত রূপ, স্ত্রী-কন্যা। অথচ কী যেন একটা নেই! 
মিলি ওর উদাসীন ভাব দেখে বলেছিল – ‘এই বয়সে ওখানে নতুন কাউকে ভালো লাগলো না কি? এখানে মন টিকছে না?’ 
নেহাত মজা করেই প্রশ্ন। তাই সেইভাবেই উত্তর দিয়েছিল সূপর্ণ। ‘বলতে পারো প্রেমে পড়েছি। কেশবিহীন এক নারীর সঙ্গে, যার সর্বাঙ্গে রুক্ষতা।‘ এই পলাশতলী এলাকাটা কেন যে সূপর্ণকে এইভাবে বেঁধে ফেললো সে নিজেও জানে না। সূপর্ণ ধীরে ধীরে বসে পড়ে বেঞ্চের উপর। সিগন্যাল ফ্ল্যাগদুটো বেঞ্চের উপর রেখে পিছনের দিকে হাতদুটো ছড়িয়ে দিয়ে চোখ বোজে। সূর্য বেশ কিছুক্ষণ আগে দিগন্ত রেখার নীচে হারিয়ে গেলেও আকাশ থেকে আলো পুরোপুরি মুছে যায়নি তখনো। বিদায়ের চুম্বনের মতো এক চিলতে আলো আকাশের মুখ চুম্বন করে চলেছে। 
চোখ বুজেও সেই দৃশ্য মনের আকাশে দেখতে পায় সূপর্ণ। ওর কাজ সিগন্যাল দেখানো না হলেও গত চারদিন ধরে কেবিন সামলানোর পাশাপাশি এই কাজটাও তাকে করতে হচ্ছে। কেননা, এই কাজে নিযুক্ত ঝোড়ো মান্ডি কদিন ধরে অসুস্থ। সবচেয়ে যেটা বড়ো কথা এই স্টেশনে নতুন কর্মী খুব একটা নিয়োগ হয়না। বদলী হয়ে আসেন অন্য রেলকর্মীরা। দপ্তরের সবাই জানেন, এই স্টেশনে বদলি হওয়া মানেই পানিশমেন্ট পোস্টিং। দপ্তরে কোন না কোন অপরাধের জন্যই এই স্টেশনে আসতে হয় কর্মীদের। তাই রেলকর্মীদের সবাই এটাকে বলে জেলযাত্রা – রেলযাত্রার সঙ্গে মিল রেখে। 
তবে, সূপর্ণের এটা পানিশমেন্ট পোস্টিং নয়। বলা যেতে পারে, বহু তদবির করেই সে এই স্টেশনে পোস্টিংটা পেয়েছে। দূরের দিকে তাকালো সূপর্ণ। জনাচারেক আদিবাসী মেয়ে মাথায় ছোট ছোট গাছের ডালের বান্ডিল নিয়ে লাইন পার হয়ে লালা রাস্তাটার দিকে যাচ্ছে। অবশ্য, ওটা রাস্তা নয়। রুক্ষ মাটির উপর পড়ে থাকা পাথরের বড় বড় চাই এর পাশ দিয়ে পায়ে চলা একটা পথ। একসময় হয়তো এখানে টিলা কিংবা পাহাড় ছিল। 
এখন সেসব নেই। এমনকি, নেই কোন জঙ্গল। ধূ ধূ প্রান্তর, ছড়ানো পাথরের মাঝে বন-বাবলা, দু একটা সেগুন আর রোগা লিকলিকে দু-চারটে পলাশ। জল নেই। জলের খোঁজে ওদের সাদা শিকড় শুধু মাটির গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করে। যেটুকু জল পায়, তাতে শরীরের রুক্ষতা ঘোচে না। পাতা ঝড়ে যায়। চেহারা উজ্জ্বলতা হারায়। শুধু উপরের বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে। বসন্তে ফুল ফোটায়, তবে, সেই ফুলে আর আর আগুন ধরে না। বন উজাড় হয়ে গেছে। এখানে পাখি আসে না। বৃষ্টি মেঘ হয়ে আসে। মেঘ হয়েই ফিরে যায়। এখানের মাটিতে ফেলে না চোখের জল। অগ্নিদগ্ধ এই মালভূমি অঞ্চলের মাটিতে সেভাবে ফসল হয় না। নেই কাজ। 
বাড়ির মরদরা কেউ ঢুকেছে কারখানায় মজুর হিসাবে, কেউ পাড়ি দিয়েছে বর্ধমান, রাচি কিংবা প্রতিবেশী রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে। পরিযায়ী। কথাটা ভাবতেই মনে মনে খুশি হয় সূপর্ণ। অসম্ভব সুন্দর এই শব্দটা। জীবনের সব রূপ যেন লুকিয়ে রয়েছে এই ছোট্ট শব্দটার মধ্যে। সারাটা জীবন সে তো পরিযায়ী হতে চেয়েছিল। সল্ট লেকে যখন পরিযায়ী পাখিরা আসতো, সে োদের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতো ঘন্টার পর ঘন্টা। হিংসা হতো ওদের জীবনকে। বন্ধনে থেকেও বন্ধনহীন এক জীবন। উড়ে চলা মাইলের পর মেইল। কখনো অনুকূল, কখনো বা প্রতিকূল পরিবেশ। বেঁচে থাকা, আগত সন্তানদের বড় করা, তারপর শীত ফুরালে বার ফিরে চলা। এখানেও তো সেই বাড়ির টান। ফেলে আসা দেশের টানে ফিরে যাওয়া। এটাই কি তাহলে জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। 
সূপর্ণ, পরিযায়ী পাখিদের কাছ থেকে কী শিক্ষা নিল? পরিযায়ী জীবন? না কি, দেশের টানে আবার ফিরে যাওয়া? সূপর্ণ তার ভাবনার জগতে তলিয়ে গিয়েছিল। সময়ের হিসাবও ছিলনা। সিতাই এর খনখনে কন্ঠস্বরে চেতনা ফিরলো। চোখ খুলতে যেটা প্রথমে দেখল, সেটা সিতাইএর মুখ। তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু আগেই সিতাই তাকে ডাকছিল। সূপর্ণ ধড়ফড় করে উঠে দাড়ালো,। তারপর ফ্ল্যাগদুটো তুলে নিয়ে দেখলো, বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। স্টেশনের মিটমিটে আলোগুলো জ্বলে উঠেছে।
 ‘সূপর্ণদা, টাটানগর থেকে গাড়ি আসার সময় হয়ে গেল। মাস্টারবাবু কেবিনে যেতে বললেন। আমি কেবিনে গিয়ে দেখলাম কেউ নেই। আপনাকে খুঁজতে এসে দেখলাম, আপনি ঘুমোচ্ছেন।‘
 বাংলা-দেহাতি মিলিয়ে একটা কথা বলে থামলো সিতাই। 
সূপর্ণের পাশাপাশি কেবিনের দিকে হাঁটতে  হাঁটতে সিতাই একটু ফিশফিশ করে বলে, ‘সাধু আজও বস্তায় করে কী একটা নামালো। আমার হাতে একশো টাকা দিয়ে বস্তাটা মাথায় চাপিয়ে চলে গেল।‘ ‘তাতে হয়েছে টা কি? এর আগেও তো তোকে দু-একশো দিয়েছে। টিকিট তো কাটে না। শুনেছি টাটানগরের আগেই নেমে যায় গাড়ি থেকে। আর শোন, ওই সাধুকে নিয়ে আমার একটুও আগ্রহ নেই। শুনেছি ও একটা বড় চোর। ওর ‘সাধু’ নামটা কে রেখে ছিল কে জানে! তবে, যেই রাখুক, সে বেঁচে থাকলে, একবার ডেকে এনে দেখাতাম। বলতাম, দেখে নাও – তোমার সাধু কেমন নামের সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করছে। সূপর্ণের কথা শুনে সিতাইও হেসে ওঠে।
 তারপর বলে, ‘বেশ বলেছেন। একেবারে সাধু।‘ তারপর একটু হেসে বলে, ‘আমার তো ছুটি হয়ে গেল। যাই, একটু ঝিলিকের বাড়ির দিকে। ওর বর ওর জন্য একটু মাংস কিনে দিয়ে আসতে বলেছে।
চলবে...
<</<

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad