ধারাবাহিক উপন্যাস -'কারো ছায়া নেই' ২

ছোটনাগপুর মালভূমির আদিবাসী অধ্যুষিত রুক্ষ প্রান্তরে সবুজের আচ্ছাদন দিতে চেয়েছিলেন এক দেহাতি অশিক্ষিত মানুষ। শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভের পর সন্ন্যাস জীবন বেছে নেওয়া আর একজন এসেছিলেন মানুষের রুক্ষ-সুক্ষ-মরুপ্রায় মনোভূমিতে ভালোবাসার সজল ধারা বইয়ে দেওয়ার জন্য। ডাইন-প্রথা, জানগুরুদের মাঝে নিদারুণ দারিদ্র্য, কর্মহীনতা, মহাজনদের নিষ্পেষনে কেমন আছে ভূমিপুত্র আর ভূমিকন্যারা? আজ দ্বিতীয় ভাগ
ক অসমাপ্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দক্ষিন-পূর্ব রেলের এক শুনশান স্টেশনে বদলি নিয়ে এলেন সূপর্ণ। আর তারপর… জীবনের নানা অধ্যায় আর রুক্ষ মাটির বুকে এ এক অন্য রূপকথা, যে রূপকথায় মৃত্যুর ছায়া পড়ে, কিন্তু জীবনের প্রান্তরে কারো ছায়া নেই। সূপর্ণ প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় দোতলা কেবিনে এসে ঢোকে। ঝোড়ো এসে পড়েছে। ফলে, আজ তার উপর চাপটা কম। 
ফ্ল্যাগগুলো ঝোড়োর হাতে দিয়ে বলে, ‘জংশন থেকে ফোন এসেছিল নাকি?’ 
‘আসে নি, তবে আসবো আসবো করছে।‘ ঝোড়ো হেসে বলে। 
‘শুনলাম, আজ আপ-ডাউন মিলিয়ে গোটা ছয়েক গাড়ি আসবে। কারখানায় নাকি জোর কদমে কাজ চলছে। বিদেশে রপ্তানীর বরাত আছে। তাই তিন শিফটে কাজ হচ্ছে।‘
 ঝোড়ো থামে। তারপর কেবিন ঘরের কোনের দিকে রাখা চায়ের ফ্লাস্কটা নিয়ে আসে। রেললাইনের দিকে কাচের পাল্লাটা খুলে দিয়ে জানালার পাশে রাখা একটা চেয়ারে বসে পড়ে সূপর্ণ। এই স্টেশনের আধুনিকীকরণ বলতে যা হয়েছে, তা হলো, আর লাইন পাল্টানোর জন্য লিভার টানতে হয় না। এখন তার সামনে একটা প্যানেল। সেখানে লাল, সবুজ আলোর বিন্দু। 
বাবা মারা গিয়েছিল সূপর্ণর হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষার সময়। একটা পথ দূর্ঘটনা কেড়ে নিয়ে নিয়েছিল ছয় জনের সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী মানুষটাকে। শোক কাটিয়ে সে দেখা করেছিল রেলদপ্তরে। যদি বাবার চাকরীটা পাওয় যায়। বহু তদবির করে শেষ পর্যন্ত কাজ জুটেছিল রেলে। লিভারম্যান পোস্টে। গ্রুপ ডিতে। পড়াশোনা আর এগোয় নি। তারপর নানা বাধা টপকে কেবিনম্যান ও সবশেষে এখন ট্র্যাফিক ইন-চার্জের পোস্টে।
সূপর্ণ জানালার ভিতর দিয়ে বাইরে তাকালো। অন্ধকার নেমে এসেছে। আকাশে আধখানা চাঁদ ঝুলে আছে। আর কদিন পরেই পূর্ণিমা। ওইদিন এলাকার প্রধান ছেদিলালের ছেলের মুখে-ভাত। কোয়ার্টারে এসে নিজেই নিমন্ত্রণ করে গেছে। 
এছাড়া ওদিন আদিবাসীদের একটা উৎসবও আছে। পুর্ণিমার রাতে টুংরীর বুকে যে নতুন চড়া পড়েছে, তার উপরে সারারাত নাচ-গান, খাওয়া-দাওয়া চলবে। এই প্রখর গরমে টুংরীতে একটুও জল নেই। অবশ্য কোন সময়েই বা জল থাকে? ঝাড়খন্ডের দিক থেকে মনে হয় দামোদর থেকেই বেরিয়ে এসেছিল এই নদীটা। তারপর জামরা গ্রামের দক্ষিণ দিক দিয়ে মাইল খানেক গিয়ে মিশে গেছে কাজরী নদীর সঙ্গে। এই কাজরী নদীতে প্রবেশের মুখেই সেই চড়া। পাশেই ভূমিজদের গ্রাম টোরা। এখানেই আশপাশের গোটা ছয়েক গ্রামের ভূমিজ, মুন্ডা, বীরহর আর সাঁওতাল পরিবারের মানুষজন আসবেন এই বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে নাচ-গানে মাততে। 
খেরিয়া শবরদের দু একটা পরিবার টোরা গ্রামে আছেন বংশ-পরম্পরায়। বাড়ির যুবকরা এখানে কাজ না পেয়ে মহারাষ্ট্র-গুজরাতে চলে গেছেন। তারাও এইসময়টায় গ্রামে ফেরেন। 
‘তোরও নেমন্তন্ন আছে না সরপঞ্চের বাড়ি?’ সূপর্ণ চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে ঝোড়োর দিকে তাকিয়ে বলে কথাটা। ঝোড়ো বেশ শব্দ করে কাচের গ্লাসে নেওয়া চায়ে চুমুক দেয়। 
তারপর বলে, ‘আমাকে ছাড়া চলবে না কি ওই ছেদিলালের। কী ছিল ওর। রাঁচি থেকে ৪০ মাইল দূরের গাঁয়ে পড়ে ছিল। কাজও পেত না। খাওয়াও জুটত না। নিয়ে এসেছিলাম তো আমিই ওকে। এখানে আমার পয়সাতেই তো চলতো ওর। তারপর আমার সঙ্গে টাকা ধার নিয়ে বালি আর পাথরের কাজ শুরু করে। এখন তো দেখতেই পাচ্ছেন, ও কোথায়? আর আমি কোথায়?’ 
সূপর্ণ বোঝে ছেদিলালের ব্যাপারে খুব একটা সন্তুষ্ট নয় ঝোড়ো। ওর এই আচমকা উত্থানের নেপথ্যে কী সবাই জানে, বোঝে। কিন্তু মুখে বলার সাহস নেই কারো। তাই আড়ালে-আবডালে সবাই প্রধানের বিরুদ্ধেই কথা বলে। আর এই ভাবেই মনের রাগ মেটায়। সূপর্ণ জানে, ওদের রাগের সঠিক কারণ ওরা নিজেরাই বোধহয় জানেন না।
সূপর্ণ চায়ে চুমুক দেয়। তারপর ঝোড়োর দিকে ত্তাকিয়ে বলে, “আচ্ছা ঝোড়ো, রামলালকে বেশ কিছুদিন দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় গেল বলতো?” 
ঝোড়ো চ্যের গ্লাসটা ধুয়ে প্যানেল বোর্ডের কাছে যাচ্ছিল। সামনে রাখা টেলিফোনটাতে ডায়াল করতে করতে বলে, “আমিও দেখিনি অনেকদিন।“ ওপ্রান্তে মনে হয় কেউ কিছু বলছিল। তাই ঝোড়ো চুপ করে গেল। অন্যপ্রান্তের কথা শেষ হলে ফোন রেখে প্যানেল বোর্ডের দিকে এগোয়, তারপর বেশ কয়েকটা স্যুইচে চাপ দেয়। প্যানেল বোর্ডের লাল আর সবুজ আলোয় পরিবর্তন হয়। 
“সূপর্ণদা, টাটানগর থেকে গুডস ট্রেন আসছে, সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর দিকে যাবে। চেঞ্জ করে দিলাম। আমি প্ল্যাটফর্মে যাচ্ছি।“ ঝোড়ো ফ্ল্যাগগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল। 
 সূপর্ণ বসে ছিল। বাইরে অন্ধকার। বহুদূর থেকে গুডস ট্রেনের হর্ণ শোনা যাচ্ছে। জানালা দিয়ে রুক্ষ প্রান্তরের উপর দিয়ে বয়ে আসছে হাওয়া, তাতে নাম না জানা ফুলের গন্ধ মিশে আছে। এই গন্ধ তাকে বিবশ করে দেয়। তার মনে হয়, সে যেন বসে আছে রুখাশুখা এক টিলার উপর। দূরে শীর্ণ কাজরী, আকাশে আধখানা চাঁদ আর সেখান থেকে চুইয়ে আসা গলন্ত রূপোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। একা সূপর্ণ।

 অধ্যায় ২

 কাজরী নদী যেখানে আধখানা চাদের মতো বাঁক নিয়েছে, সেখান থেকে পূর্বদিকে মিনিট চারেক হাটলেই গোঁসাইবাবার আখড়া। রুক্ষ মাটির বুকের উপর থেকে ঠেলে ওঠা একটা ছোট্ট টিলার পাশে সেগুন গাছের গুঁড়ি, মাটি দিয়ে তৈরি দুটো ঘর আর মাথার উপর টিনের চাল। আশেপাশে গোটা কয়েক সেগুন গাছ। একটা বাবলা আর বেড়ার কাছে মৃতপ্রায় একটা পলাশ। এটাই গোঁসাইবাবার আখড়া। এখানে কোথাও কোন আলো নেই। এই শুখা প্রান্তরে মানুষের ঘরবাড়ি নেই, তাই নেই কোন আলোর ব্যবস্থা। তবে, এখান থেকে কিছুটা দূর গেলেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আদিবাসীদের গ্রাম।
 না, সেখানেও বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে বিদ্যুৎ আসবে, কিন্তু কোন এক কারণে আসেনি। ফলে, রাতের বেলায় ভরসা সেই হ্যারিকেন আর লম্ফ। যাদের একটু টাকা-পয়সা আছে, তারা সোলার ল্যাম্প কিনেছে। রাতের বেলা কয়েকঘন্টা বেশ আলো দেয়। গোঁসাইবাবার আখড়াতেও ওরকম আলো আছে। সারাদিন সূর্যের আলো খেয়ে এখন বেশ আলো দিচ্ছে ওই ল্যাম্পগুলো। 
 আর দূরের দিকে তাকালে চোখে পড়ে সার সার আলো। যেন আলোর মালা পড়ে কেউ অন্ধকারে বসে আছে। ওখানে তিনটি ফ্যাক্টরী আছে। একটা সিমেন্টের, আর একটা অভ্রের আর অন্যটা ইস্পাতের। আছে কারখানার বাইরে শ্রমিক বস্তি আর কারখানার কম্পাউন্ডের ভিতরে কারখানার অফিসার, ইঞ্জিনিয়রদের কোয়ার্টার। ওখানে গেলে বোঝা যায় জীবনের অন্যরকম অর্থ, আর এখানে কাজরী নদীর কাছে গোসাইবাবার আখড়ায় জীবনের আর এক অর্থ চোখে পড়ে। 
জীবনের মানে এক এক মানুষের কাছে যেমন এক এক রকম, তেমনই, সময়ের সঙ্গেও বদলে যায় জীবনের মানে। গোঁসাইবাবার জীবনটাও ঠিক তেমনই। জীবনের স্রোতে ভাসতে ভাসতে কাজরী নদীর বাঁকে আটকে পড়া। তারপর সেখানে আর এক জীবন, যে জীবনটা উৎসর্গ করা হয়েছে ঈশ্বরের নাম-গানে আর মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর কাজে। 
গোঁসাইবাবার আসল নাম কেউ জানে না। প্রথম যেদিন তিনি এই রুখা প্রান্তরে পা রেখেছিলেন সেদিন থেকেই আদিবাসী পল্লীর মানুষজন তাকে গোঁসাইবাবা বলে ডেকেছিলেন। তার গলায় তুলসীর কন্ঠী, বাহুতে তিলক-স্বরূপ। মাথার চুলে জটার আভাস। বয়স সঠিকভাবে বোঝা না গেলেও পঞ্চাশের আশেপাশেই হবে। তবে, তার চেহারার মধ্যে আকর্ষণীয় হল তার দু-চোখ। সেখান থেকে যেন জ্ঞানের দীপ্তি ঝরে পড়ছে। চোখের মধ্যে নেই কোন রুক্ষতা, নেই রাগের প্রকাশ। এক অদ্ভুত শান্ত দু-চোখ, ঠিক যেন গাছের ছায়ায় ঢাকা কোন নিস্তরঙ্গ পুষ্করিণী। আর তার উজ্জ্বল মুখে এক শান্তির আলো। গোঁসাইবাবাকে দেখলে মনে হয়, তিনি যেন এই জগতের কেউ নন। রুখা প্রান্তরে তার এই শীতলতা মানায় না। জীবন যেখানে প্রতি মুহুর্তে জীবনের সঙ্গে লড়াই করে, সেখানে গোঁসাইবাবার উপস্থিতি যেন সময়কে থামিয়ে দেয়। যেন বলতে চায়, এখানে ছায়া নেই তো কী হয়েছে। আমার এখানে এসো, আমি তোমাদের দেব শান্তি আর ছায়ার ঠিকানা।
একটানা ঝিঁঝির ডাক আর দূর ফ্যাক্টরি থেকে শিফট চেঞ্জের সাইরেনের শব্দের মাঝে কারো পায়ে চলার আওয়াজ। অন্ধকারে একটা টর্চের আলো এসে পড়ে আখড়ার বেড়ায়। বেড়ার কাঠের দরজা সরিয়ে ভিতরে ঢোকে সাধু। সকালের সাধুর সঙ্গে এখনকার সাধুর কোন মিলই নেই। প্যান্ট ছেড়ে পড়েছে একটা সাদা কাপড়। গায়ে ফতুয়া। গলায় তুলসীর মালা। 
 পোষাক বদলালে কী মানুষটাই বদলে যায়? বদলে যায় তার চরিত্র? ধর্মের কি কোন নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম থাকে। একদিন থাকতে না পেরে কথাগুলো বলেই ফেলেছিল গোঁসাইবাবাকে। 
 ‘আচ্ছা,গোঁসাইবাবা, এই যে এতো সাধু-সজ্জন আমাদের দেশে। কেউ লাল বস্ত্র পড়ে, কেউ গেরুয়া, কেউ সাদা। কেউ মাথায় জটা রাখে, কারো মাথা ন্যাড়া। এসব কী জন্য? ধর্ম করতে গেলে কি নির্দিষ্ট রঙের কাপড় লাগে?’ 
কথাগুলো বলেই সাধু তাকিয়েছিল গোঁসাইবাবার মুখের দিকে। গোঁসাইবাবা কী একটা বই পড়ছিলেন। মুখটা একটু তুলে একদৃষ্টে তাকিয়েছিলেন সাধুর দিকে। 
তারপর শান্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘বুঝলি সাধু, ধর্মের আসল অর্থটাই আমরা বুঝি নে, তাই ধর্মের নামে এতো লড়াই, এতো কুসংষ্কার চারিদিকে। যদি বুঝতাম, তাহলে এই দেশটাই অন্য হয়ে যেত। সত্যটা কী জানিস, কাপড় যে রঙেরই হোক, মনটা হবে সাদা। মাথা ন্যাড়াই হোক, আর জটাই থাকুক, সেই মাথার ভিতরে থাকবে মানব আর প্রকৃতির মঙ্গলের চিন্তা। নিজের আখের গোছানোর জন্য ধর্ম নয়। অন্যকে সঠিক জীবনের পথ দেখানোটাই ধর্ম।‘ 
সাধু চুপ করে শুনেছিল। তারপর মাথা চুলকে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘আচ্ছা গোঁসাইবাবা আমার নাম সাধু। আর আমার কাজ হলো ট্রেনে উঠে যাত্রীদের দামি জিনিষপত্র চুরি করা। এতে আমার পাপ হচ্ছে না?’ গোঁসাইবাবা হেসে ফেলেছিলেন সাধুর এই আত্মবিশ্লেষণের কথা শুনে। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘তোর যে হাত চুরি করে সেই হাতই আবার খোল বাজায়। 
যে প্রকৃতি এই ধরণীকে ফুলে-ফলে সাজিয়ে তোলে, সেই প্রকৃতিই আবার সবকিছু লণ্ডভন্ড করে দেয়। তবে, সাধু, তুই যে কাজটা করছিস, সেটা ঠিক নয়।‘ কথাগুলো বলেই চুপ করে গিয়েছিলেন গোঁসাইবাবা। মাটির দুয়ারে ওঠার আগে সাধু বালতিতে রাখা জল নিয়ে নিজের দু পায়ে ঢালে। জল এখানে মহামূল্যবান জিনিষ, বিশেষ করে পানীয় জল। তবে, গোঁসাইবাবার আখড়ায় পা ধোয়া, চান করার জলের অভাব নেই। পাশেই কাজরী নদীতে এখনো জল আছে। কষ্ট করে তুলে নিয়ে আসতে হয়। পা ধুয়ে ঘরে ঢোকে সাধু। গোঁসাইবাবা ঘরের মেঝেতে চাটাই পেতে রেখেছেন। পাশে শ্রীখোল রাখা। 
ঘরের মধ্যে থাকার মধ্যে রাধা-কৃষ্ণের একটা বাঁধানো ছবি, কাঠের একটা চৌকির উপর রাখা। নীচে সেবা দেওয়ার পিতলের থালা। আর তার পাশে প্রচুর বইপত্র। সাধু জানে, গোঁসাইবাবা বইপত্র ভীষন ভালোবাসেন। মাঝে মাঝে সকালের টাটানগরের ট্রেন ধরে চলে যান। কোথায় যান, কেউ জানে না। একইসঙ্গে ট্রেনে উঠলেও সাধু ব্যস্ত থাকে যাত্রী অনুসন্ধানে। কার কাছে কী দামি জিনিস আছে, সঙ্গে ক’জন আছে, কীভাবে, তা হাতানো যায় – এসব নিয়েই ছক কষতে সে ব্যস্ত থাকে। এরই ফাঁকে গোঁসাইবাবা কোথায় যে নেমে যান, আর নজরে আসে না। 
‘কীরে, আজ এতো দেরি হল যে?’
 ‘তা এট্টু হল বটে। আসলে, একবার দ্বারিকাপ্রসাদের কাছে গেছিলাম। অনেকদিন ধরে ঘোরাচ্ছে বেটা। ওর কাছে হাজার কয়েক টাকার মোবাইল ফোন আর বেশ কয়েকটা দামি স্মার্ট ঘড়ি দিয়েছিলাম। ব্যাটা আজ দাম দেবো, কাল দেবো, বলে খুব ঘোরাচ্ছিল। আজ কিছু আদায় করে নিয়ে এলাম। তাও এখনো হাজার দুই পাবো। বলেছে, আর কিছু দামি জিনিসপত্র নিয়ে এলেই বাকি টাকাটা দিয়ে দেবে।‘ গোঁসাইবাবা জানেন এই দ্বারিকাপ্রসাদের কথা। অতি ধুরন্ধর লোক। কোথাকার মানুষ কে জানে! তবে, লোক ভালো নয়। একদিকে চোরাই মালের কারবার করে। অন্যদিকে গায়ের গরীব-গুর্বো মানুষগুলোকে সুদের বিনিময়ে টাকা ধার দেয়। সোজা কথায় মহাজনী কারবার করে। 
এই রুখা-শুখা প্রান্তুরে কাজ কোথায়, চাষের জমি নেই বললেই হয়। বৃষ্টি নেই। নদীতে জল থাকে না। পাথুরে মাটি খুঁড়ে চাষ করাও বেশ কঠিন। যখন এখানে ফ্যাক্টরি হল, এখানকার মানুষগুলো ভেবেছিল, তারা সবাই কাজ পাবে, সকাল-সন্ধ্যে পেট ভরে খেতে পাবে। তা আর হল কই? সেইতো বাইরে থেকেই শ্রমিক এলো। এখানকার মানুষের হাল সেই আগের মতোই। মাঝ থাকতে হারালো জঙ্গল। সেখানে ডাল-পাতা কুড়িয়ে তবু চলত, এখন, সেটাও নেই। মাঝে মাঝে কাগজে পড়েন, সরকার এখানকার আদিবাসীদের জন্য অনেক কিছু করছে, কিন্তু, সেসব দেখা যাচ্ছে কই? 
গোঁসাইবাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তারপর সাধুর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আজ আর কেউ আসবে না? অনন্তর আসার কথা ছিল। দেখা হয়েছে না কি ওদের সঙ্গে?’ ‘না গো গোঁসাইবাবা, তবে, শুনছিলাম, এবার পূর্ণিমার রাতে টুংরীতে নাচ-গানের আসর বসছে। আবার দেখেন কান্ড ওইদিনই আবার আমাদের সরপঞ্চের ছেলের মুখে-ভাত। শহর থেকে কে সব নেতা-টেতা আসবে। তারাও না কি টুংরীতে নাচ-গানের আসরে যোগ দেবে। আমি তো ওইসব শহুরে নেতাদের একদম দেখতে পারি না। বড়ো বড়ো কথা বলে, সব মিথ্যা। আর এক একটা হারামী, মেয়েছেলে দেখলে হামরে পরে।‘ 
‘হারামি’ আর ‘মেয়েছেলে’ শব্দদুটো বলেই লজ্জায় জিভ কাটে সাধু। ‘কিছু মনে করবেন না গোঁসাইবাবা, আলটপকা বেরিয়ে গেছে।‘ সাধুর চোখে-মুখে একটা কাঁচুমাঁচু ভাব। গোঁসাইবাবা দেখলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। বাস্তব তো তাই। হয়তো সাধু জানে না কোন জায়গায় কীভাবে ওই কথা বলা উচিত বা কোন শব্দ ব্যবহার করা উচিত। ও যে সমাজে বাস করে, সেখানকার মানুষজন এভাবেই কথা বলে। এর মধ্যে কেউ দোষের কিছু দেখে না। তবে সাধু যেভাবে জিভ কেটে ক্ষমা চাইলো, সেটা প্রমান করে, ওর মধ্যে এখনো ভাষার রুচি বা কুরুচির দিকটা হারিয়ে যায় নি। 
গোঁসাইবাবা সামনে রাখা হারমোনিয়ামটা টেনে নিলেন। তারপর রিডের উপর আঙুল চালাতে চালাতে বললেন, ‘আজ কোনটা গাওয়া যায় বলতো?’ সাধু খোলটা টেনে নিতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিয়ে বললো, ‘আজ গান থাক গোঁসাইবাবা, একটা কথা মনে পড়ে গেল।‘ 
‘কী কথা?’ ‘ইস্টিশনের সূপর্ণবাবু আছে না, বলছিল, তোর গোঁসাইবাবার সঙ্গে একবার দেখা করতে যাব।‘ ‘কী ব্যাপার রে, হঠাৎ এই ভিখিরির সঙ্গে? শুনেছি উনি রেলের বড় অফিসার। ইচ্ছে করেই এই রুখা স্টেশনে বদলি নিয়েছেন। কলকাতায় না কি মেয়ে বউ থাকে।‘ সাধুও বোধহয় সূপর্নবাবু সম্পর্কে এতো কথা জানতো না, যতটা জানেন গোঁসাইবাবা। 
সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে গোঁসাইবাবার দিকে। বাকি কথা বলতেও ভুলে যায়। তবে গোঁসাইবাবাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে বলে, ‘সূপর্ণবাবু বলছিলেন, কোথায় যেন দেখেছি তোদের গোঁসাইবাবাকে। বড্ড চেনা চেনা লাগে।‘ 
‘ওঃ সেইজন্য। 
ভালো। ওনাকে তাহলে বলিস, কাল আমি আখড়াতেই থাকবো। চলে আসতে পারেন।‘ 
গোঁসাইবাবার কন্ঠস্বর শান্ত। সেখানে কোন কৌতুহলের চিহ্ণ খুঁজে পেল না সাধু। সে চুপ করে বসে রইলো। গোঁসাইবাবা আর কিছু বললেন না। শুধু উদাস হয়ে তাকিয়ে রইলেন বাইরের অন্ধকার আকাশের দিকে। 
খোলা দরজা দিয়ে এক ঝলক হাওয়া ঢুকল ঘরে। ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারটাকে দুলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল জানালা দিয়ে। নাকে এলো নদীর জল, বুনো ফুল আর কারখানার ধোঁয়ার মিশ্র একটা গন্ধ। সাধু গোঁসাইবাবাকে চুপ করে যেতে দেখে আর কিছু বলল না। দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ বাইরে থেকে কাদের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। 
মেয়েলি গলা শুনে সাধু উঠে দাঁড়িয়ে টর্চটা নিয়ে বাইরে বের হলো। গোঁসাইবাবার মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। একটু পরেই ঘরে ঢুকল সাধু। সঙ্গে দুই আদিবাসী যুবতি। গায়ের রঙ কিন্তু যথেষ্ট ফরসা। পরনে কমদামী ছাপা শাড়ি। মাথার খোঁপায় বুনোফুল। সেই বুনোফুল আর তাদের যুবতী শরীরের গন্ধে কেমন এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হলো যে সাধু কিছুটা বিব্রত হয়ে গোঁসাইবাবার দিকে তাকালো। গোঁসাইবাবা ওদের দিকে সরাসরি তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। 
তারপর বললেন, ‘ঝিলিক, ফুলমণি, তোরা এখন? কী হয়েছে?’ ‘গোঁসাইবাবা, কাল একবার আমাদের ঘরে আসতে হবে।‘ কথাটা একসঙ্গেই বলে ওরা। তারপর তাকিয়ে থাকে গোঁসাইবাবার দিকে, সম্মতির আশায়। 
চলবে <</<

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad