বাবাজী মহারাজ কী চেয়েছিলেন?


তারক ঘোষ

বেশ কিছু বিষয় নিয়ে শ্রীশ্রী স্বামী . প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া মহারাজের আক্ষেপ ছিল সর্বসমক্ষে মাঝে মাঝে সে কথা বলে ফেললেও, বেশিরভাগ সময় নিজের মধ্যেই সে কথা রেখে দিতেন যখন একান্ত পারতেন না, তখন বলে ফেলতেন সব সাধু যে এক নয়, সকলের উদ্দেশ্য যে এক নয়, সেই কথাটা বাবাজী মহারাজ হাজার চেষ্টা করেও বুঝিয়ে উঠতে পারেন নি আমাদের এই সমাজে যেমন অনেকসাধুরূপী চোর বা ডাকাত আছে, যারা দেখবেন পুলিশের জালে মাঝে মাঝেই ভারতের নানাপ্রান্ত থেকে ধরা পড়ে, জেলে যায়, তেমনই সত্যিকারের সাধু-সন্ন্যাসীও রয়েছেন

 দুঃখের বিষয় অসৎসাধুদের জন্যই দূর্নাম হয় সৎ সন্ন্যাসীদের আর এক শ্রেণির সাধু আছেন, যাদের মূল উদ্দেশ্য হলো শিষ্য সংখ্যা বাড়ানো যে কোনভাবে ধনী শিষ্যের সংখ্যা এরা বাড়িয়ে চলেন ঘুরে বেড়ান ধনী শিষ্যদের বাড়ি বাড়ি সেখানে গিয়ে আবার শিষ্য তৈরি করেন উদ্দেশ্য, মানুষের মঙ্গল সাধন বা তাদের সঠিক আধ্যাত্মিক পথ দেখানো নয়, শিষ্যদের অর্থে নিজের জীবন চালানো অনেকটা ব্যবসার মতো বাবাজী মহারাজ বা জানকীদাসজী মহারাজ এই সমস্তগুরুদের কাছ থেকে দূরে থাকার উপদেশ দিতেন কারণ, গুরু যদি নিজেই বিষয়ে আসক্ত হন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ সংগ্রহ করেন, বিলাসী জীবন যাপন করেন, তার যদি শিষ্যদের দেওয়ার মতো আধ্যাত্মিক জ্ঞান কিছু না থাকে, শুধু নেওয়ার থাকে, তিনি গুরু হওয়ার উপযুক্ত মোটেই নন এদের কাছে দীক্ষা নিয়ে, কাজের কাজ কিছু হয় না যারা কাঠিয়বাবাদের জীবন কথা পড়েছেন, তারা এটা সকলেই জানেন শিষ্যদের সঠিক পথ দেখাতে পারেন একমাত্র সদগুরুরা কিন্তু, সদগুরু চেনা খুব কঠিন সদগুরুদের মধ্যে অনেক লক্ষণ থাকে এই লক্ষণ যাচাই না করে শুধু জটা-দাড়ি দেখে বড়ো সাধক ভেবে পায়ে গিয়ে পড়লে শেষপর্যন্ত ঠকে যেতে হয়

আর একটা বিষয়, শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য গুরুদেবের নামে প্রতিষ্ঠান তৈরি করাটা গুরুভক্তির লক্ষণ নয়, এতে গুরুদেবকেই অর্থলোভী মনে করতে পারেন প্রকৃত ভক্তরা গুরুদেবের নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানকে দাতব্য হতে হবে সেখানে মানুষ যেন বিনা পয়সায় সুবিধা পায়, বা বাজার চলতি অর্থের বদলে অনেক কম অর্থে পরিষেবা পায়

আমাকে বাবাজী মহারাজের এক ভক্ত-শিষ্য বলেছিলেন, ‘ইচ্ছা আছে বাবার নামে একটা হাসপাতাল করিবলেছিলাম, ‘আপনার ইচ্ছাটা অতি মূল্যবান কিন্তু, দেখবেন, হাসপাতালের নামে নার্সিং হোম খুলে বা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল বানিয়ে রোগীদের সর্বস্বান্ত করার ব্যবস্থা করবেন না কারণ, বাবার নামাঙ্কিত হাসপাতালের সঙ্গে যদি অন্য হাসপাতাল বা নার্সিং হোমের কোন পার্থক্য না থাকে, অর্থ গুনে পরিষেবা পেতে হয়, তাহলে কোথায় যেন সবাই বুঝে ফেলেন, ওনার গুরুদেব বোধহয় এটাই চেয়েছিলেন

এই প্রসঙ্গে আমার গ্রন্থ রচনা সম্পর্কে বলি আমি বাবার নানা সময়ের নানা কথা নিয়ে যে গ্রন্থ রচনা করছি, সেগুলির জন্য পাঠকদের কাছ থেকে প্রকাশকের খরচ বাদ দিয়ে বই পিছু মাত্র ৫৯ টাকা আমি রয়ালটি বাবদ পাই এই অর্থ জমা রেখে আমার ইচ্ছে বাবাজীর একটা প্রবচন কেন্দ্র তৈরি করা, যেখান থেকে আমাদের টেলিভিশন মিডিয়ার সাহায্যে বাবার বাণী বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়া এই কাজের জন্য, আমি কারো কাছ থেকে কোন দান, অর্থ সংগ্রহ করি না নিজের সঠিক পথের উপার্জন থেকে তা করার চেষ্টা করছি পাঠকরা যদি মনে করেন, তারা কিনতে পারেন না ইচ্ছা হলে, তারা কিনবেন না

গুরুদের নামে দোকান-ব্যবসা খুলে অনেকেই এসব করেন এটা গুরুভক্তি না গুরুদেবের নামটাকেইউনিক সেলিং প্রাইসবা USP হিসাবে ব্যবহার করা হয়, সেটা বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা সহজেই বুঝে যান


অবশ্য শিষ্য যেমন, তার গুরুদক্ষিণা তেমনই হয় সবাই একলব্য হতে পারেন না, সবাই স্বামীজী হন না সবাই আমাদের বাবাজী মহারাজ হতে পারেন না কারণ মহাপুরুষরা শতাব্দীতে একজন কি দু জন আসেন যদি য়ে য়ে জন্মাতেন তাহলে মুড়ি-মুড়কির এক দর হয়ে যেত অবশ্য, যেত কেন বলছি, হয়ে যাচ্ছিল আর সেখানেই ছিল বাবার আপত্তি, পরোক্ষ একট সূক্ষ অভিযোগ

অনেকেই বাবাকে সাধারণ একজন সন্ন্যাসী ভেবে নিয়েছিলেন, তাই অন্য সন্ন্যাসীদের মতোই বাবাকে দেখতে শুরু করেছিলেন অন্নপ্রাশন, উপনয়ন দেওয়ার জন্য বাবার কাছে আবদার আসতো ভক্তদের বাবা হয়তো শিষ্যদের দুঃখ দিতে পারতেন না বলে, সেই ব্যাপারে খুব একটানাবলেন নি, কিন্তু, একবার বিরক্তির সঙ্গে আশ্রমেই বলে ফেলেছিলেন – ‘তোরা আমাকে কী মনে করেছিস, তোদের জ্বালায় আমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে দেখছি এইজ্বালাশব্দটা অন্যকে অসম্মান করার জন্য ব্যবহার করেন নি, করেছিলেন, নিজের অবস্থানটা কোথায় পৌঁছে যাচ্ছে সেটা বোঝানোর জন্যতাই অনেক কষ্ট নিয়েই তিনি বলেছিলেন – ‘আমি কেন এসেছি, এই কথাটাই কেউ আমার কাছে জানতে চাইলো না

 এটা যে কতবড়ো কথা, তা খুব সহজে বোঝা যায় না কারণ, বাবাজী এই ধরণীতে শিষ্য বাড়ানো বা আশ্রম বাড়ানোর জন্য আসেন নি এসেছিলেন মানব কল্যাণের জন্য কী সেই মহান উদ্দেশ্য, আমি চেষ্টা করবো আপনাদের সামনে তুলে আনার বাবার খুব কাছের কিছু মানুষজনের কাছে বলে যাওয়া সেই উদ্দেশ্য শুনলে আপনারা বুঝতে পারবেন, অন্যদের চেয়ে বাবাজী মহারাজ কেন আলাদা ছিলেন তিনি কেন সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে এতোটা উৎসাহী ছিলেন তার গবেষণার মূল উদ্দেশ্য কী ছিল বিদ্যালয়-লাইব্রেরী স্থাপনের পিছনে তার কী উদ্দেশ্য ছিল কেন তিনি জাত-পাতের ব্যাপারে নতুন ব্যাখ্যার প্রবর্তন করেছিলেন কেন চেয়েছিলেন বিজ্ঞানমনষ্ক ধর্মের প্রবর্তন

যাই হোক, এই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বাবার লেখা জানকীদাসজীর জীবন-চরিত থেকে একটু অংশ আপনাদের বলি – ‘গুরু যে কি জিনিস তা বুঝতেই অনেকের জন্ম কেটে যায় খাঁচার মধ্যে টিয়াপাখিকে শেখালে সেরাধেশ্যাম-রাধেশ্যামবলে, কিন্তু বেড়ালে ধরলে তার আসল বুলি ট্যাঁ ট্যাঁ বের হতে থাকে।। সেরকম বিপদ-আপদের সময় নিজের অপ্রিয় কিছু ঘটলে বা আমার পছন্দমাফিক কথা  গুরুদেব না বললে গুরুভক্তি ছুটে যায় শ্রীগুরুদেবকে স্বয়ং ভগবান জেনে তার চরণে নিজেকে সমর্পন করে দিতে পারলে তবেই শ্রীগুরুদেব তার ভার নেন


 বিভিন্ন মঞ্চে বাবাজী মহারাজের দেওয়া ভাষণ বা আশ্রমের সান্ধ্য প্রবচন বা অসম বা এই রাজ্যের নানা জায়গায় বাবাজী যে সমস্ত বক্তব্য রেখেছেন, সেগুলি যদি ভালোভাবে শোনেন, তাহলে বুঝতে পারবেন, তার মূল লক্ষ্য কী ছিল তার বক্তব্যে বারে বারে উঠে এসেছে ব্যক্তি-মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ আর সামাজিক অবক্ষয়ের কথা সোজা ভাষায় বলতে গেলে বলা যেতে পারে, সমাজ চেতনা আর এই সমাজ চেতনার প্রথম অঙ্কুরটি মাথা চাড়া দেয় একেবারে বালক অবস্থাতে

নানা ধরণের ঘটনা, বিদ্যালয় জীবনের অভিজ্ঞতা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অভিজ্ঞতা তাকে এই সমাজ সম্পর্কে নানা অভিজ্ঞতা প্রদান করে পাশাপাশি, তার শ্রীগুরুদেব তাকে এমন কিছু কর্তব্য করার দায়িত্ব দিয়ে যান, যা একেবারেই এই সমাজ-কেন্দ্রিক স্বভাবতইঃ বাবাজী মহারাজের জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয়িত হয়েছে সমাজের মঙ্গল সাধন সেই মঙ্গল সাধনের পথ খুঁজে বের করায়


এই সমাজের বুকে নানা ঘটনা, পুজোকে কেন্দ্র করে উশৃঙ্খলতা, মানুষের প্রেম অপ্রেম, দেব-দেবীরভরনামক কুসংষ্কার, মানুষের লোভ-লালসা তার পরিণাম, একশ্রেণির সাধুদের জীবন-যাপনসবকিছুই ছিল তার নজরে তিনি নিয়ে অনেক কথা বলেছেন এই ধরণের অনিয়ম, স্বেচ্ছাচার থেকে বেরিয়ে আসার পথ বা উপায় বলেছেন নিজেও ভেবেছেন, এই সামাজিক অবক্ষয়ের সঠিক উৎস কি, তা নিয়ে তাই আমাদের বাবাজী মহারাজ এই পৃথিবীতে নিছক একজন ধর্মীয় গুরু হিসাবে আসেন নি আশ্রমে বসে জ্ঞান বিতরণ, কিংবা শিষ্য বাড়ি ঘোরা কিংবা পুজো-পাঠের মধ্যে তার স্বল্পকালীন জীবন সীমাবদ্ধ ছিল না তিনি এই সমাজকে এমন কিছু দিতে এসেছিলেন, যাতে, ভারতীয় সমাজ সনাতন ধর্ম কুসংষ্কার ছেড়ে এগিয়ে যেতে পারে বিশ্বে এই সনাতন ধর্ম হয়ে উঠতে পারে এক উল্লেখযোগ্য ধর্ম হিসাবে

মানুষের হানাহানি তাকে ব্যথিত করেছে বার বার, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যে অধঃপতন, তাকে ভাবিয়েছে তিনি তার প্রবচনে বার বার সাবধান করেছেন, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে, এর পরিণাম নিয়ে বে-আইনি পথে অর্থ উপার্জন, জাত-পাতের লড়াই নিয়েও সরব হয়েছেন বারংবার একশ্রেণির সাধুদের ত্যাগী জীবন ভোগের জীবনকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন বুঝিয়ে দিয়েছেন, সাধু কাকে বলে, সাধুদের সঠিক পথ কর্ম কী দূর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা বুঝিনি নিজেরাই পাপ করছি, আর মুক্তির উপায় জানতে ছুটছি মন্দিরে, জ্যোতিষির কাছে, কিংবা গুরুর কাছে একবারো ভেবে দেখছি না, ‘য্যায়সি করনি, ত্যায়সি ভরনি

বাবাজী জানতেন, ভারতের সাধু সমাজের একটা বিরাট দায়িত্ব আছে সমাজের প্রতি তারা যদি সমাজ সম্পর্কে উদাসীন থাকেন, তাহলে এই সমাজ একসময় নানা অনাচার আর পাপে পূর্ণ হয়ে উঠবে তিনি, তাই জগত ঈশ্বরকে সমানভাবে দেখেছেন অর্জিত জ্ঞান ধর্মের সাহায্যে কীভাবে মানুষের অন্তর বাহিরিকে পরিষ্কার করা যায়, সেই কথা শুধু ভাবেন নি, কাজেও তা করে যাচ্ছিলেন বহু কাজ তিনি করেছেন সবার অগোচরে

তার মূল লক্ষ্য ছিল সমাজ তার গবেষণার বিষয় ছিল সমাজ আর এই সমাজ নিয়ে গবেষণা, ভাবনা নতুন চিন্তার বিষয়ে পথ-প্রদর্শক ছিলেন শ্রীজানকীদাসজী তিনি বাবাজী মহারাজের গবেষণার বিষয় নির্বাচন করে দিয়েছিলেন মার্ক্সের চিন্তাধারা তার সঙ্গে নিম্বার্কীয় চিন্তাধারার মিশ্রনে এই সমাজের খোল-নলচে পালটে দেওয়া যেতে পারে বলে, তিনি মনে করতেন মার্ক্স নিম্বার্ক মতবাদ গড়ে উঠেছিল বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই আধ্যাত্মিক সমাজতত্ববিদ নিম্বার্ক এর পরামর্শ ছিল সমাজের ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে সমতা উপলব্ধির মাধ্যমে সমাজকে পরিবর্তন করা মার্ক্স ও নিম্বার্ক উভয়েরই ভাবনার ভিত্তিভূমি ছিল মানবিকতা

বাবাজী মহারাজ বলেছেন, বর্তমান সমাজের একটা শ্রেণি, দূর্বল আর একটা শ্রেণিকেএক্সপ্লয়েটকরে একটা শ্রেণি আর একটা শ্রেণিকে শোষণ করে অধিক পেতে চায় এর ফলে, সমাজে সৃষ্টি হয় শোষণ বঞ্চনার একটা ধারাবাহিকতা মার্ক্স নিম্বার্ক তাই চেয়েছিলেন এমন একটা শ্রেণিহীন সমাজ যেখানে একটা শ্রেণির সমৃদ্ধি, অন্য শ্রেণির উন্নতির পথে বাধা হবে না

তিনি বলছেন, ভারতের আধ্যাত্মিক সমাজবিদদের একটা বড়ো অংশ চিরন্তন সত্য, ঈশ্বর জ্ঞানের পিছনে দৌড়ান, পিছনে পড়ে থাকে মানুষের প্রাথমিক চাহিদাগুলো, উপেক্ষিত হয় বেচে থাকার উপকরণ সংগ্রহের প্রচেষ্টা যার পরিণতিতে, আধ্যাত্মিকতা এখানে সাধারণ মানুষের জীবনে খুব একটা সফল হয় না তাদের অন্তরকে সেইভাবে জাগাতে পারে না অন্যদিকে মার্ক্সের কমিউনিজম মানুষের কিছুবেসিক চাহিদাপূরণ করতে পারলেও, দিনের শেষ সব চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ

শিল্পের উন্নতি সমাজ-জীবনকে প্রভাবিত করে, উন্নতি ঘটাতে পারে মানুষের সামাজিক অবস্থানের যতক্ষণ না মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটে এবং তাকে সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া যায়, ততক্ষণ সম বণ্টনের স্বপ্নকে জীবনের মধ্যে আনা যাবে না

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad