তারক
ঘোষ
বাবাজী
মহারাজ বলতে লাগলেন- ভদ্রলোক একদিকে দান-ধ্যান করেন, যাদের প্রয়োজন, তাদের অসময়ে সাহায্যও করেন। আবার কালোবাজারী
করে উপার্জন করেন। সোজা কথায় একদিকে পাপের কাজও করেন, আবার গরীবদের দান-ধ্যান
করে পূণ্য উপার্জন করে সেই পাপ কমাবার চেষ্টা করেন। এখন বলতো, ওই ভদ্রলোক কি তার পাপকে
দানের পূণ্য দিয়ে কাটতে পারবে?”
বাবার
সামনে বসে থাকা পুরুষ-মহিলারা তখন নীরব। কারো মুখে কোন কথা নেই। কেউ কেউ মনে মনে
ভাবছেন- বেশ জটিল প্রশ্ন। সত্যিই তো, ওই ভদ্রলোক কি সত্যিই পাপী, না কি পূণ্যবান?
কেউ
ভাবছেন,
আমিও
তো কিছু ঘুষ-টুস নিই, কম দামের জিনিষ বেশি দামের বলে চালিয়ে দিই।
কেউ ভাবছেন, আমি তো আমার কালোবাজারী ব্যবসা থেকে কম কামাই না। তবে, আশ্রমেও দান-টান করি, এবার আমার কী হবে?
বাবা
প্রবচনে বসে সবার দিকে তাকিয়ে একটু মিটিমিটি হাসলেন। সেই হাসি, যে হাসির মধ্যে কোন মলিনতা
নেই,
ঠিক
শিশুর হাসি।
বললেন
–
একটা
গল্প বলি শোন। একবার একজন তার বাগানে বেড়া দেবার জন্য এক কাজের লোককে ডাকলেন।
তারপর তাকে বললেন, দ্যাখ, প্রতিদিন আমার এই বাগানে ঢুকে গরু-ছাগল সব
গাছ খেয়ে যায়। ভালো করে বেড়া দিয়ে দে তো।
ওই
বাগানের মালিক লোকটাকে টাকা-পয়সা দিয়ে যা যা লাগবে কিনে আনতে বলে চলে গেলেন। বেশ
বেলার দিকে ওই লোকটা বাগানের মালিককে ডেকে নিয়ে গেলেন বেড়া কেমন হয়েছে, দেখাবার জন্য।
বাগানের
মালিক দেখলেন, বেশ মোটা করে দু-বার করে বেড়া দিয়েছে লোকটা। বাগানের চারিদিকটা ঘুরে দেখতে
গিয়েই তাজ্জব বাগানের মালিক। দেখলেন, দু জায়গায় অল্প করে ফাঁক রয়েছে। বেড়া দেওয়া
হয়নি।
বেশ
রেগে গিয়ে বললেন, “কীরে এখানে ফাঁক কেন?” মজুর লোকটা হাত-জোড় করে
বলল,
“ওই যে সামনের দিকে মোটা করে, ডবল করে বেড়া দিয়েছি, তাই পিছনের দিকে একটু ফাঁক
রয়ে গেল।“
বাবাজী
হাসলেন। বললেন, বুঝলি কিছু?
সবাই
চুপ। বাবাজী বললেন, এত দান-ধ্যান করে পূণ্যের বেড়া দিচ্ছিস যখন, তখন ওই কালোবাজারীর আর
দূর্নীতির ফাঁকটা রাখছিস কেন? ওই পথেই তো ছাগল-গরু ঢুকে সব ফসল খেয়ে নেবে।
তোর কী থাকবে তাহলে?
বাবাজারীর
প্রতিটি কথা আমাদের সকলের মঙ্গলের জন্য। তার কথা যদি কেউ অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করে, নিজের জীবনে সেটা প্রয়োগ
করতে পারেন, তাহলে তার জীবনে কোন কষ্ট থাকবে না। এই গল্পটা বলে বাবা সেদিন বলেছিলেন, আমি বলার কেউ নই। যা করা
উচিত,
শাস্ত্রে
আছে,
তাইই
বলি। কাউকে আঘাত দেওয়ার জন্য বলি না।
এরপর
তিনি বললেন- দেখ, তোদের মতো বহু মানুষ সাধু-সন্ন্যাসীদের
প্রণাম করেই উদ্ধার হয়ে গেল, আর আমার মতো সেই সাধু-সন্ন্যাসীরা প্রণাম
নিতে নিতে হয়তো নরকে চলে গেলাম। ভাবছিস, এটা আবার হয় নাকি! হ্যাঁ হয়, কারণ, প্রণাম পেতে পেতে, গলায় মালা পরে বহু
সাধু-সন্ন্যাসী যখন নিজেদেরই ঈশ্বর ভেবে ফেলেন, তখন এটা হয়। আমরা কেউ ঈশ্বর নই। ঈশ্বরের কথা
প্রচার করি। আর তোরা যখন প্রণাম করিস, আমার মধ্য দিয়ে সেই ঈশ্বরকেই প্রণাম জানাস।
তাই তোদের ভাল হয়, আর আমরা যদি মনে করি, আমরাই প্রণাম পাবার যোগ্য, সেটাই ভুল হয়ে যায়।
এই
প্রসঙ্গে তিনি একটি কবিতার অংশ বলতেন, আপনারা একসময় এটার ভাবসম্প্রসারনও করেছেন।
“পথ ভাবে আমি দেব,
রথ
ভাবে আমি,
মূর্তি
ভাবে, আমি
দেব,
হাসে
অন্তর্যামী।“
বাবাজী
এই প্রসঙ্গে একবার একটা বিষয় উত্থাপন করলেন। ভীমের কণ্ঠ খুব শ্রুতিমধুর ছিল না।
অনেকটা রাসভের মতো মনে হতো গ্রামের সকলের। ভীম কিন্তু, সেসবে কান না দিয়ে ঠাকুরের
স্তুতি করে যেতেন। একদিন, তাকে গ্রামের লোকেরা বলল, তুমি যখন ঠাকুরের স্তুতি কর, অমন গাধার মতো চেঁচাও কেন? আমাদের খুব খারাপ লাগে।
কথাগুলো
শুনে ভীমের খুব খারাপ লাগল। তিনি ঠাকুরজীর সামনে বসে প্রার্থনা করতে শুরু করলেন, ঠাকুরজী আবির্ভূত হয়ে বললেন, বল কী চাস।
ভীম
বললেন, ঠাকুর
আমার কন্ঠটা একটু মোলায়েম করে দাও, যাতে গ্রামের লোকেদের ভালো লাগে।
ঠাকুরজী
‘তথাস্তু’ বলে চলে গেলেন। পরের দিন ভীম
যখিন ঠাকুরজীর স্তুতি করতে শুরু করলেন, কী অপূর্ব সেই কণ্ঠস্বর। গ্রামের লোকেরা ভিড়
করলেন তার স্তুতি শোনার জন্য। ভীম এতো ভিড় দেখে খুশি। মনে মনে তার বেশ গর্ব হল।
তারপর
দিনের শেষে, ঠাকুরজীকে ডাকতে শুরু করলেন। আজ আর ঠাকুরজী দেখা দিলেন না। ভীম বললেন, প্রভু, আজ আপনি দেখা দিচ্ছেন না কেন?
ঠাকুরজীর
কণ্ঠ শোনা গেল- আজ তুই গ্রামের লোককে চেয়েছিলিস, তাই ওদের পেয়েছিস, আমাকে তো চাস নি। আমি তো তোর
ওই খারাপ কণ্ঠস্বরেও তোর ডাকে সারা দিতাম।