মা, ভক্তের ভক্তির অহঙ্কারটুকুও
রাখতে দেন না।“ মানুষ যদি, নিজেকে ভক্ত ভেবে বসেন, তাহলেও অহঙ্কার জন্ম নেয়।
তারক
ঘোষ
আকাশের
সব কালো মেঘ যখন সাদা পঙ্খীরাজের রূপ নিয়ে নীল আকাশের বুকে পাল তুলে দেয়, নদীর ধারে সাদা সাদা কাশফুল
যখন হেসে ওঠে মনের আনন্দে আর উদ্দাম বাতাসের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে, বাতাসে যখন ভাসতে থাকে
আগমনীর গন্ধ, রেডিওতে বেজে ওঠে – আশ্বিনের শারদ প্রাতে…, তখন মনে পড়ে যায় – মা আসছেন। আসছেন সকলকে বরাভয়
দান করার উদ্দেশ্যে।
আর
সেই মুহুর্তে মনের অন্দরে বেজে ওঠে বাবাজী মহারাজের সেই সুললিত কণ্ঠ – এই ভিখারী সাধকের কথাটা মনে
রেখো - ‘দূর্গাপুজো
আত্মসমালোচনার সময়’।
দূর্গাপুজোর
সময় বাবা যেতেন নানা জায়গায়। কখনো অসমে, কখনো এই রাজ্যের নানা স্থানে। আলোচনা হতো, মায়ের স্বরূপ নিয়ে, দূর্গাপুজোর তাৎপর্য্য নিয়ে।
মা চন্ডী, শুম্ভ-নিশুম্ভ
থেকে মহিসাষুর বধ – পৌরাণিক ব্যাখ্যা থেকে, আধুনিক ব্যাখ্যা। বর্তমান
সমাজের উপযুক্ত করে বাবাজী মহারাজ বুঝিয়ে বলতেন, দেবী দূর্গার দশহাত ও দশ অস্ত্রের তাৎপর্য্য, দেবী সরস্বতী, মা লক্ষী, গনেশ, কার্তিক ও তাদের বাহনের
ব্যাখ্যা। সুন্দরভাবে বাবা বুঝিয়ে বলতেন। পুজো কথাটার তাতপর্য্য কী, বলি দেওয়া বলতে ঠিক কী বোঝায়, বাবা শাস্ত্রমতে
ও বিজ্ঞানের তত্ব দিয়ে তা সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন। ‘বলি’ বলতে বেশিরভাগ মানুষ এখনো
পশুবলিকেই বোঝে। দেবীর সামনে তারই সৃষ্টিকে হত্যা করে মানুষ সেই
পশুর মাংস ভক্ষণ করে ‘প্রসাদ’ হিসাবে।
সত্যিই কি এর মধ্যে ধর্ম থাকে? না কি ‘বলি’ শব্দটার প্রকৃত অর্থ না বুঝে, বা, না বোঝার ভান করে ‘বিনা মূল্যে’ মাংস ভক্ষণের আয়োজন করা হয়? দেবী, যিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্ত্রী, তাকে আমরা ‘লোভ’ বা ‘ঘুষ’ দিচ্ছি না তো - মানতের নামে?
‘মা, আমার এই প্রার্থনা পূরণ করে
দাও, তাহলে
দুটো পাঁঠা বলি দেব।
এটা
কী! বাবা এর প্রতিবাদ করেছিলেন, প্রবচনে বসে ও লিখিতভাবে, তার প্রবন্ধের মাধ্যমে। তিনি
বললেন, ধর্মে
পশুকে বলি দেওয়ার কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পশুত্বকে বলি
দেওয়ার কথা। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় জলধর সেনের লেখা সেই অসামান্য ছোটগল্প ‘বলি’ র কথা। আর মনে পড়ে কবিগুরুর
সেই বিখ্যাত কবিতা ‘ছুটির আয়োজন’ ---
“আর দেখেছি, সামনে দিয়ে স্টেশনে যাবার
রাঙ্গা রাস্তায়
শহরের-দাদন-দেওয়া
দড়ি-বাঁধা ছাগল-ছানা পাঁচটা-ছটা করে;
তাদের
নিষ্ফল কান্নার স্বর ছড়িয়ে পড়ে
কাশের
ঝালর দোলা শরতের শান্ত আকাশে।
কেমন
করে বুঝেছে তারা
এল
তাদের পূজার ছুটির দিন।“
বাবা
বললেন –“সন্ধি
পূজায় বলি দেওয়ার যে বিধান আছে, সেটা আসলে ছাগ ও মহিষ কাটা নয়। ‘বলি’ অর্থে নিজের ভোগ-সুখকে বলি
দেওয়া। এটা আত্মশকিকে জাগরিত করে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে – বলং বর্ধনং দদাতি ইতি বলি।“
নীচের
ভিডিওটি দেখতে পারেন।
বাবা
তার ‘রানাস’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘অকাল বোধন’ প্রবন্ধে বললেন – “সমাজ জীবনে আজ আকাল দেখা
দিয়েছে। চারিদিকে দলাদলি, অশান্তি, অসুরদের দাপাদাপি। শান্তি নেই কোথাও। শুভবুদ্ধি
রূপিণী মা আমার আজ নিদ্রিতা। মানুষের কলঙ্কিত সতারূপী অসুরদের আজ জয়জয়কার। ভক্তের
হৃদয় আজ কেঁদে বেড়াচ্ছে শক্তির শুভ পরিবেশের জন্য।“
বাবা
বহু বছর ধরে দেখেছেন, ধর্মের নামে ঠিক ধর্ম হচ্ছে না। দূর্গাপুজো এখন
একটা উৎসব। কিন্তু উৎসবের সুর বাঁধা আছে ধর্মের সঙ্গে, সেদিকটাকেও মনে রাখা যে
প্রয়োজন, এটা
কিছু মানুষ ভুলে যাচ্ছেন। বাবা বললেন – মায়ের দশ হাত দশ রিপুর প্রতীক। আর দশ হাতের দশ
অস্ত্র, সেই
রিপুকে জয় করার জন্য। অসুর দমন রিপু দমনের প্রতীক আর পায়ের নীচে সিংহ পশুবৃত্তি
দমনের প্রতীক।
বাবা বললেন, “মানুষ যেদিন তার ইন্দ্রিয়বৃত্তি ও রিপু জয় করে ভাবের চালক, পালক, ধারক ও পোষকরূপে দূর্গাকে উপলব্ধি করতে পারবে, তখনই যথার্থ দূর্গাবোধন সম্ভব।“
তিনি
বললেন – “ক্রোধের
প্রতীক মহিষ, লোভের প্রতীক ইক্ষু তথা আখ। কলা হলো মোহের প্রতীক, কুমড়ো হল ‘মদ’ তথা অহঙ্কারের প্রতীক।
পরনিন্দা-পরচর্চার প্রতীক হলো সুপারী। পূজায় এই সমস্ত বলির বিধান আছে।“
বাবা
বললেন, তাহলে
পুজোর সময় কী কী বলি দিতে হয়? ছয় রিপুর। এই ছয় রিপুকে খুঁজে পাওয়ার জন্য
দরকার আত্মসমালোচনার। নিজেকে চিনতে হবে। জানতে হবে। মনের অন্ধকার কোনে জ্বালতে হবে
শুভবুদ্ধির দীপ। নইলে অন্ধকার মনের আঙ্গিনায় দেবীর বোধন হবে কীভাবে?
চলবে…