তারক ঘোষ
ছোট্ট ছেলে-মেয়ে যখন ‘মা মা’ বলে কেঁদে ওঠে,
মা তখন আর থাকতে পারে না। ছুটে এসে সন্তানকে কোলে তুলে নেয়। দেখে সন্তান কেন কেঁদে
উঠল। ভগবানের কাছে, মা দূর্গার কাছে, গুরুদেবের
কাছে আমরা সবাই সেই ছোট ছোট সন্তান। আমরা যদি আকুল হয়ে মা কে ডাকি মা সাড়া না দিয়ে
পারে না। গুরু বা ভগবানও তাই। কিন্তু সেই আকুল হয়ে আমরা ক’জন তাকে ডাকতে পারি? মায়ের
কাছে সন্তান যে আকুতি নিয়ে ছুটে যায়, সেই আকুতি আমাদের ক’জনের আছে? কে আমাদের বাধা
দেয়? কেন আমরা পূর্ণরূপে নিজেদের সমর্পণ করতে পারি না শ্রীগুরু পদে, মায়ের চরণে?
বাবাজী মহারাজ বললেন –শুম্ভ-নিশুম্ভ রূপ অস্মিতা
আমাদের বাধা দেয়। আর এই শুম্ভ-নিশুম্ভ রূপ অস্মিতা মহিষাসুরের চেয়েও ক্ষমতাশালী। কিন্তু,
এই অস্মিতা থাকে কোথায়? কেন সে আমাদের বাধা দেয় নিজেদের মায়ের চরণে পূর্ণরূপে সমর্পণ
করতে?
অস্মিতা থাকে আমাদের মনে, আমাদের বুদ্ধিতে।
সেখানে বসেই সে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু, সে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কেন?
পারে আমাদের জন্যই। কারণ আমাদের পাপবোধ। আমরা যতক্ষণ নিজেদের পাপী ভাববো, আমরা কিছুতেই
নিজেদের মায়ের চরণে পূর্ণরূপে সমর্পণ করতে পারবো না। আমাদের পাপবোধ আমাদের বাধা দেবেই।
কিন্তু, এই পাপবোধ কেন?
বাবাজী বললেন, ভগবান কারো পাপ নেন না, পূণ্যও
নেন না। দেবী চণ্ডী বলছেন, আমিই মানুষের নিয়ন্তা। যা কিছু করাচ্ছি, আমিই করাচ্ছি। খারাপ,
ভালো – সব কিছুই। মানুষ যন্ত্রমাত্র। যন্ত্রী হলেন মা।এই বুদ্ধি নিয়ে যদি মানুষ চলে,
তার সব পাপের দায়িত্ব মায়ের। কিন্তু, ‘ভালো কাজ আমি করেছি’, আর ‘খারাপ কাজ সব মা করিয়েছে’
– এই বুদ্ধি জাগ্রত হলে বিপদ তারই।
মা বলছেন – আমি যখন তোদের নিয়ন্তা, সব কিছু
হচ্ছে, আমার ইচ্ছাতেই। তোর কোন অধিকার নেই। না পাপের উপর উপর, না পূণ্যের উপর।
আসলে, মনের মধ্যেই, ইন্দ্রিয়ের মধ্যেই রয়েছে
মহিষাসুররূপ রজোঃগুণ, শুম্ভ-নিশুম্ভ রূপ অস্মিতা আর মমতা। রজোঃগুণকে জয় করলেও আমাদের
মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ না করতে পারলে, আমরা মাকে পূর্ণরূপে দেখতে
পাবো না, নিজেদেরও পূর্ণরূপে মায়ের চরণে স্থাপন করতে পারবো না।
কিন্তু, এর মাঝে আছে একটা বাধা। ভাগবতে এই
বাধাটাকেই বস্ত্র বলা হয়েছে। বস্ত্র হলো শেষ বাধা। বস্ত্র অর্থাৎ আবরণ। বস্ত্র হলো পৃথকত্ব। এর মানে মায়ের সঙ্গে, গুরুর
সঙ্গে আলাদা করা।
বাবাজী বলছেন – আমরা মায়ের চরণে প্রণাম করার
সময়, শ্রীগুরুর চরণে প্রণাম জানানোর সময় ভাবি, আমি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলীন করে দেব
তাদের শ্রীচরণে। আমার আর কোন আলাদা অস্তিত্ব থাকবে না প্রণাম করার সময়। কিন্তু, তার
পর আবার একটা বোধ জেগে ওঠে। আমি হাজার পাপে পাপী, আমি প্রচুর দোষ করেছি। জন্ম-জন্মান্তরের
পাপে আচ্ছন্ন সংষ্কারের মলিন বস্ত্র আমি পড়ে রয়েছি। আমি কীভাবে পারবো মায়ের চরণে, শ্রীগুরুর
চরণে নিজেকে নিবেদন করতে!
এটাই হলো অস্মিতা। পাপবোধ। আর এই পাপবোধ আমাদের
মাতৃচরণে যেতে দেয় না। মা বললেন – সবকিছুর যখন আমিই নিয়ন্ত্রণকারী, তখন তোর তো আর অধিকার
থাকে না। মানুষ যদি সম্পূর্ণরূপে নিজেকে ঈশ্বর-নিয়ন্তা বলে ভাবতে পারে, তাহলে তার পাপ
থাকে কোথায়? সে নিজেকে পাপীই বা ভাববে কেন?
ভগবান কারো পাপ নেন না, কারো পূণ্যও নেন না।
মানুষ অজ্ঞানে আবৃত বলে, নিজেদের পাপী বলে ভাবে। প্রকৃতি তার কাজ করে চলে, আর অহঙ্কারে
আবৃত মানুষ ভাবে, সে নিজেই কাজ করছে। কিন্তু, তত্ববিদ মানুষ জানে, সে নিজে কোনকিছুই
করছে না। ঈশ্বর যখন মানুষকে যন্ত্রের মতো ব্যবহার করে কাজ করাচ্ছেন, তখন আর মানুষের
পাপ কোথায়?
তোমার কিছু করার নেই। তোমার নিজের কর্মের
উপর যখন তোমার নিয়ন্ত্রণ নেই, তখন তোমার পাপ কোথায়? তাহলে মায়ের চরণে পূর্ণরূপে নিজেকে
বিলিয়ে দেওয়ার বাধা আর কোথায়?
বাবা বললেন, এই যে মায়ের সঙ্গে পৃথকত্ব, পাপী-তাপী
বোধ – এটা অস্মিতা। এই হল শুম্ভ। আর এই অস্মিতার সঙ্গে থাকে তার ভাই নিশুম্ভ – মমতা।
মমতা হলো – ‘আমার আমার’ বোধ। সবকিছু আমিই করেছি।
চলবে…