তারক ঘোষ
কুম্ভমেলা। যার অঙ্গে অঙ্গে জড়িয়ে আছে পুরাণ আর ইতিহাস। সময়ের পথ পেরিয়ে
আজও অম্লান এই মেলার তাৎপর্য্য। আজও ভারত তথা বিদেশের অগণিত মানুষ ছুটে যায় কুম্ভের
টানে। কী সেই টান, কেন আজও সেই অমোঘ টানে মানুষ
ছুটে চলে কুম্ভে! সত্যিই কি সেই কুম্ভে আজও মেলে অমৃত? না কি অমৃত কুম্ভের মধ্যে আজ
শুধুই হলাহল। দেবতা-ভোগ্য অমৃতের অধিকার এখন কি অসুরদেরও?
যতবার কুম্ভমেলা কভার করতে গিয়েছি, এই প্রশ্নগুলো আমায় টেনেছে। ঘুরেছি তাঁবুতে,
তাঁবুতে, কথা বলেছি বহু সাধু-সন্ন্যাসী-দেহাতি মানুষজনের সঙ্গে। অমৃত কুম্ভে এসে কেউ
পান করেছে হলাহল, কেউ বা পূণ্যের স্বপ্ন নিয়ে শুধ ছুটেই গেছে এক কুম্ভ থেকে অন্য কুম্ভে।
আমাদের বাবাজী মহারাজও এই কুম্ভে দেখেছেন অমৃত আর বিষের সহাবস্থান। মেলায় নানা অসামাজিক
কাজকর্ম, একশ্রেণির সাধুদের কামনা পূরণের নানা ছলা-কলা তাকে ব্যথিত করেছে। তিনি বারবার
এই প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের কাছেও বলেছেন।
মনে পড়ে সমরেশ বসু তথা কালকূটের লেখা সেই অসামান্য উপন্যাস ‘অমৃত কুম্ভের
সন্ধানে’ এর বেশ কয়েকটি লাইন – “এই রাস্তায় আজ
আমরা চলেছি, কুম্তের যাত্রীরা। যদি খুলে দিই এই রাস্তার পুরানো ইতিহানের পাতা, তবে খুঁজে পাব বুঝি গৌতম বুদ্ধের পদরেণু। কান পাতলে শুনতে পাব বিজয়ী মৌর্য্যবাহিনীর পদশব্দ। দেখতে পাব মুগ্ধচিত্ত গ্রীক-রাজদূত মেগাস্থিনিসকে, চীন-পর্ঘটক ফা-হিয়েনকে। শুনতে পাব সমুদ্রগুপ্ত ও হর্ষবর্ধনের রথচক্রের ঘর্ঘরানি। পদচিহ্ণ খুঁজে পাব জুয়ানজাং আর
শঙ্করাচার্ষের।“
জানা যায়, কুম্ভমেলা কয়েক হাজার বছরের বেশি পুরনো। চিনা পরিব্রাজক জুয়ানজাং এর লেখায় এই মেলার কথা
প্রথম জানা যায়। এবার একটু তাকানো যাক পুরাণের দিকে।
কুম্ভ নামকরণ হয়েছে
পুরাণের অমৃতকুম্ভ বা অমৃতের পাত্র থেকে। পুরাণ মতে, বৈদিক যুগে দেবতা আর অসুর দের মধ্যে সব সময় ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকত। একসময় মহর্ষি দুর্বাসা মুনি ক্রদ্ধ হয়ে দেবরাজ ইন্দ্রকে অভিশাপ
দেন। অভিশপ্ত হয়ে দেবতারা হয়ে পড়েন শক্তিহীন। সৌভাগ্যের দেবী
লক্ষী স্বর্গ ত্যাগ করে আশ্রয় নেন ক্ষিরোদ-সাগরে। ফলে, দেবতারা পড়ে যা্ন মহা-বিপাকে।
উপায়ন্তর না দেখে তারা ছুটে যান প্রজাপতি ব্রহ্মা আর মহাদেব এর
কাছে। উদ্দেশ্য, শাপস্খলন
করা। কিন্তু, তারা দুজনেই তাদের পরামর্শ
দেন শ্রীবিষ্ণুর কাছে যাওয়ার জন্যে। দেবতারা বিষ্ণুদেবের
কাছে সমাধান পাওয়ার আশায় গেলে তিনি বলেন দুধসাগর মন্থন করে অমৃতের কুম্ভ তুলে
আনতে হবে। সেই অমৃত পান করলে দেবতারা অমর হবেন। আর সমুদ্র-মন্থনে আবার উঠে আসবেন লক্ষী।
কিন্তু, সমুদ্র-মন্থন ছিল এক অতি কঠিন কাজ। আর এই কঠিন কাজ করা একা দেবতাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না বলে তারা অসুরদের সঙ্গে এক সমঝোতায় আসেন। তাদের শর্ত ছিল অমৃতের অর্ধেক তারা অসুরদের দেবে্ন। এরপর মেরু পর্বতকে বানানো হয় মন্থন দণ্ড আর সর্পদেব বাসুকি হলো মন্থনের দড়ি। শুরু হলো সমুদ্র-মন্থন। আর এই মন্থনে একে একে উঠে আসতে থাকল ঐরাবত, উচ্চৈশ্রবা, কল্পবৃক্ষ, দেবী লক্ষী। অবশেষে, প্রায় হাজার বছর মন্থনের পরে ধন্নন্তরি উঠে আসেন অমৃতপাত্র নিয়ে। কিন্তু দেবতারা বুঝতে পেরে যান এই অমৃত যদি অসুররা পান করে অমর হয়ে যায়, তাহলে তাদের আর পরাজিত করা সম্ভব নয়। আর শেষে উঠল তীব্র হলাহল। মহাদেব সেই বিষ পান করে হলেন নীলকন্ঠ।
দেবতাদের পরমধন অমৃত কুম্ভের কথা জানতেন দেবরাজ ইন্দ্র। ওই কুম্ভ যাতে দেবতাদের হাতছাড়া হয়ে অসুরদের হাতে না পড়ে, তার জন্য পুত্র জয়ন্তকে নির্দেশ দিলেন দেব-বৈদ্যের কাছ থেকে অমৃত-কুম্ভ চেয়ে নিয়ে পালিয়ে যেতে। পিতা ইন্দ্রের আদেশ পাওয়া মাত্রই অমৃত ভরা কুম্ভ নিয়ে ছুটতে লাগলেন জয়ন্ত।
অসুর
গুরু শুক্রাচার্য ব্যাপারটা লক্ষ করে অসুরদের আদেশ দিলেন জয়ন্তকে ধরতে। আগে জয়ন্ত
ছুটছেন অমৃত কুম্ভ নিয়ে- পিছনে ছুটছে অসুররা। এইভাবে সমানে তিনদিন ছোটার পর একটু
বিশ্রামের প্রয়োজন ভেবে জয়ন্ত বিশ্রাম নিতে বসলেন অমৃত কুম্ভটি মাটিতে রেখে। কিন্তু, কতক্ষণই বা সময়!
জয়ন্ত দেখলেন অসুররা এসে পড়েছে। আবার ছুটতে শুরু করলেন ইন্দ্রপুত্র। টানা তিনদিন
ছুটে বসলেন আবার বিশ্রাম নিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হলেন
অসুররা। আবার কুম্ভ নিয়ে ছুটতে লাগলেন জয়ন্ত। এইভাবে জয়ন্ত তিনদিন পর পর অমৃতপূর্ণ
কুম্ভ নামিয়ে রেখেছিলেন ভারতের চার জায়গায় এবং বারোদিন পরে
ফিরে আসেন সমুদ্র মন্থন ক্ষেত্রে। কুম্ভ নিয়ে পালানোর সময়
জয়ন্ত হরিদ্বার, প্রয়াগ,
নাসিক আর উজ্জয়িনীতে অমৃতকুম্ভ
নামিয়ে রেখে বিশ্রাম করেছিলেন।
একটানা
তিনদিন ছোটার পর জয়ন্ত এক একটি জায়গায় উপস্থিত হয়েছিলেন এবং ফিরে এসেছিলেন বারোদিন
পরে। মানুষের এক বছর দেবতাদের কাছে একদিন মাত্র। সে জন্য প্রতি তিন বছর অন্তর
অন্তর চার জায়গায় কুম্ভমেলা হয়, পূর্ণ কুম্ভ হয় বারো বছর পরে। হরিদ্বার আর
প্রয়াগে পূর্ণ অমৃত কুম্ভ হয় এই দু-জায়গায় কয়েক ফোঁটা অমৃত পড়েছিল বলে।
বাবাজী মহারাজ এই
কুম্ভমেলা প্রসঙ্গে বলেছেন – যে বছর প্রয়াগরাজে গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমে চড়ার উপর মাঘমাসে
কুম্ভমেলা হয়, তার ঠিক তিন বছর পর শ্রাবন মাসে নাসিকে গোদাবরী তীরে, তার পরের বছর উজ্জয়িনীতে
শিপ্রাতীরে বৈশাখ মাসে এই মেলা হয়। এর ৫ বছর পর মাঘ মাসের শেষ থেকে ফাল্গুনের শেষ পর্যন্ত
বৃন্দাবনে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সমস্ত সাধুরা মিলিত হন। চৈত্রের প্রথমে সেখান থেকে হরিদ্বারে
যান। হরিদ্বারের গঙ্গাতীরে চৈত্রের শেষ থেকে বৈশাখ পর্যন্ত পূর্ণকুম্ভ মেলা হয়।
ইন্দ্র-পুত্র জয়ন্ত
অমৃত-কুম্ভ নিয়ে পালানোর সময় বিভিন্ন দেবতাদের আদেশ দেওয়া হয়। সূর্যকে দায়িত্ব দেওয়া
হয়, যেন অমৃত গলে না যায়। চন্দ্রকে বলা হয় অমৃতে যেন ঢেউ না ওঠে। বৃহস্পতিকে আদেশ দেওয়া
হয় অসুরদের হাত থেকে অমৃত রক্ষা করার। আর শনিকে
বলা হয় জয়ন্তের উপর নজর রাখতে, যেন সে সব অমৃতটাই খেয়ে না ফেলে।
এবার এর আধ্যাত্মিক
তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা করে বাবাজী মহারাজ বললেন – জ্ঞান সূর্যের কাজ জ্ঞান-প্রগল্ভতায়
অমৃত যেন গলে গিয়ে অপাত্রে বিসর্জিত না হয়। মনের অধিপতি চন্দ্রের কাজ হলো জ্ঞানের অহঙ্কার
বা বাচালতা যাতে প্রকাশ না পায়, সেটা দেখা। বৃহস্পতি বা শ্রীগুরুর দায়িত্ব হলো রিপুর
হাত থেকে রক্ষা করা। শনির দৃষ্টি থাকে অমৃত যাতে স্বার্থের কারণে ব্যবহৃত না হয়। সেটা
যেন লোককল্যাণে ব্যয়িত হয়।
আমাদের দেহ হলো সেই
কুম্ভ, যার মধ্যে রয়েছে অমৃতরূপ আত্মা। আর সেই অমৃতের অধিকার নিয়ে মনের মধ্যে আজও চলছে
সু আর কূ প্রবৃত্তির লড়াই।