তারক ঘোষ
আমাদের প্রতিবেদনে যা যা বলা হচ্ছে
বা হয়েছে, তা বাবাজী মহারাজ নানা ভিডিওতে নিজের মুখেই বলে গেছেন। কিছু কুসংষ্কারাচ্ছন্ন মানুষ আছেন, যারা এই নিয়ে তর্ক করেন ও বাবাকে অলৌকিক তকমা
দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাদের জানাই, আমাদের
বাবাকে ওই ধরণের নানা কুসংষ্কারের মধ্যে রেখে নিজের মূর্খামীর পরিচয় দেবেন না এবং বাবা
কী করছিলেন ও করতে চেয়েছিলেন, তা না জেনে অযথা আজেবাজে মন্তব্য
করবেন না। তিনি ছিলেন দার্শনিক, নতুন মতবাদের প্রবক্তা এবং বিজ্ঞান ও ধর্মের
মেলবন্ধনের পক্ষে। তিনি ছিলেন
কুসংষ্কারবিরোধী, অলৌকিকতায়
অবিশ্বাসী। ‘ভয়েস ৯ নিউজ
গ্রুপ’ তথা ‘সংবাদ ভয়েস ৯’ ফেসবুকে বাবাজী মহারাজের (ডক্টর শ্রীশ্রী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া মহারাজ) উপর যে গ্রুপ
চালায়, তা তথ্য প্রমানের উপর ভিত্তি করে। কাজেই, কুসংষ্কারমনা, যুক্তিহীন মানুষদের এই গ্রুপ কোনভাবেই
স্বাগত জানাবে না। কারণ বাবাজীর
সত্য আদর্শ প্রচার করার ভাবনাই আমাদের প্রধান।
২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী
প্রকাশিত ‘জনমত’ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বাবাজী
নিজেই বলেছেন -
“আমি
ভগবানকে ডাকতে সাধন ভজনই শুধু করতে আসিনি। সাধন ভজনের জায়গাতো আছেই। আমি চাই, আমি যতটুকু জানতে পেরেছি আমার সাধনায়, অল্প শিক্ষায়, তা মানুষের মধ্যে ভাগ করে একটা সুস্থ
সমাজ গড়ে তুলতে। এই হানাহানি বন্ধ করতে। হিংসাকে জয় করতে শেখাতে। লোভকে সংবরণ
করতে।“
মনে রাখবেন, বাবাজী বলতেন - ভক্তি ভালো, কিন্তু ভক্তির আতিশয্য ভালো নয়। কাজেই
ভক্তির আতিশয্যে যদি তার লক্ষ্যকে আমরা ভুলে যাই, তাহলে ভবিষ্যতের পৃথিবী আমাদের ক্ষমা
করবে না।
তিনি মানুষের উপর
‘দেবতার
ভর’ বিষয়টি নিয়ে বলেছিলেন - “মানুষের উপর দেবতার ভর
হওয়া, এই
ব্যাপারটা আমি বিশ্বাস করিনা। এগুলোর পিছনে উদ্দেশ্য থাকে, অনেক সময়, মৃগি রোগের শিকার হওয়া
কোন রমনীকে বিশেষ উদ্দেশ্যে ‘ভর’ হয়েছে বলে
প্রচার করে, সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে
অনেক অসাধু কাজ করা হয়।“
একজন সাংবাদিক হিসাবে, আমি বহুবার বাবাজী মহারাজের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা
করেছি, তিনিও নানা স্থানে ওই কথাগুলো বলে গেছেন। কাজেই, বাবাজীর নিজ-মুখে বলে যাওয়া কথার চেয়ে একশ্রেণির কুসংষ্কারাচ্ছন্ন
ব্যক্তিদের নিশ্চয় আমরা গুরুত্ব দেব না। এই কথাগুলো বললাম, এই কারণে এক ‘অচৈতন্য’
ও কুসংষ্কারাচ্ছন্ন এক ব্যক্তির মন্তব্য নিয়ে। যেহেতু, বাবাজী ছিলেন সংষ্কারক, তাই এই গ্রুপে কুসংষ্কার ছড়ানোর
জন্য, তাকে আমরা গ্রুপ থেকে বের করে দিয়েছি। কারণ, কিছু না জেনে, পড়াশোনা না করে, জ্ঞান অর্জন না করে, যুক্তিহীন কথার মাধ্যমে কাউকে কালিমালিপ্ত
করার চেষ্টা অনুচিত।
এখানে বাবার এতজন ভক্ত আছেন, তাদের আচরণ আমাদের মুগ্ধ করে, তাদের ভক্তি আমাদের নতুন করে এগিয়ে চলার প্রেরণা জাগায়। কতিপয় ব্যক্তি যদি মনে করেন, এসব করবেন, তাহুলে জেনে
রাখুন, আমরা ভিতু নই, তথ্য, প্রমান ও মানুষের সাক্ষাতকারের উপর নির্ভর করে প্রতিবেদন লিখি। কারণ, এটা একটা ডিজিটাল সংবাদপত্র, যার পাঠক সংখ্যা একবছরে
১ লক্ষ ৯১ হাজার। দেশ-বিদেশের বহু বাঙ্গালী পাঠক এই লেখাগুলো পরেন। আমাদের উদ্দেশ্য মানুষ যাতে বাবাজী মহারাজের আসল
লক্ষ্য বুঝতে পারেন। বাবাজী
মহারাজ বলতেন –‘প্রত্যেক সৎ শিষ্যের
উচিত গুরুদেব যাতে তার আদর্শে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারেন, তাতে সাহায্য
করা।‘ এটা মনে রাখতে পারলেই আমাদের মঙ্গল।
আমি আজ যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা
করবো, তার মধ্যে আছে বিজ্ঞানের এক অতি
আধুনিক তত্ব যা ব্লক ইউনিভার্সিটি তত্ব নামে পরিচিত। অথচ, আশ্চর্য্যের বিষয় হলো বিজ্ঞানের এই অতি আধুনিক তত্ব প্রাচীন সাধক তথা যোগীরা
ধ্যানের সাহায্যে অনায়াসে আয়ত্ব করেছিলেন।
আধুনিক বিজ্ঞানের আগে
ভারতে ঋষিদের বিজ্ঞান ছিল, তাদের গবেষণা বেদ ও পুরাণে পাওয়া যায়, অনেক কিছু আজও খুব নির্ভুল। প্রাচীন বিজ্ঞান ধ্যানের
মাধ্যমে ইন্দ্রিয়গুলির বাইরে অনুসন্ধান করেছিল, তাই এর ফলাফলগুলি একেবারেই বৈধ। সনাতন ধর্মে
বেদে বিজ্ঞানের এমন বর্ণনা রয়েছে যা আধুনিক বিজ্ঞানীদের কাছে নেই। একটি সংস্কৃত
প্রবাদ আছে 'সত্য
নস্তি পার ধর্ম'। যার অর্থ 'সত্যের চেয়ে বড় কোনো ধর্ম নেই'। ধর্ম ও
বিজ্ঞানের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। দু'জনেই সত্যের সন্ধান করেন কিন্তু ভিন্ন উপায়ে। বিজ্ঞান
যেখানে আমাদের বুদ্ধিকে আলোকিত করে, ধর্ম আমাদের আত্মাকে আলোকিত করে। স্বামী বিবেকানন্দের মতে, বিজ্ঞান হ'ল এমন জিনিসগুলির অধ্যয়ন যা আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব
করা যায়, অন্যদিকে ধর্ম হ'ল এমন জিনিসগুলির অধ্যয়ন যা আমাদের ইন্দ্রিয়
দ্বারা অনুভব করা যায় না।
শ্রীগীতাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
বলছেন, আমি কাল। কাল অর্থাৎ সময়। এই সময় কী, এর গতি কী প্রকারের, সময়ের মাত্রা কী আছে, না কি সময় নিজেই চতুর্থ মাত্রা? বিজ্ঞান স্বীকার করে
নিয়েছে, সময় চতুর্থ মাত্রা। দৈর্ঘ, প্রস্থ, বেধ ও সময়। কিন্তু, সময় ঠিক কী, এর রহস্য এখনো ভেদ করা সম্ভব হয় নি।
কিন্তু, সময়ের নাগাল পাওয়া সম্ভব ধ্যানের সাহায্যেই, বলছেন বিশিষ্ট গবেষকরা। আর এই ধ্যান এতো সহজ নয়। চোখ বন্ধ করে বসে পড়লাম। ১০-২০ মিনিট কাটিয়ে উঠে পড়লাম, এটা ধ্যান নয়। ধ্যান সেই অবস্থা, যেখানে দেহের বোধ লুপ্ত হয়, দেহের ইন্দ্রিয়গুলির কোন কাজ থাকে না। দেহ হয়ে যায় মন কেন্দ্রিক। বাইরের কোন কিছু সেই ধ্যা্নমগ্ন দেহে কোন প্রভাব ফেলে না। মন হয়ে যায় নিষ্কম্প প্রদীপ শিখার মতো অচঞ্চল।
মন তখন
দেহ থেকে মুক্ত হয়ে মিশতে চায় সেই পরমাত্মা তথা ভগবান তথা মহাকালের সঙ্গে। যিনি ধ্যানের
সেই উচ্চ সোপানে পা রাখতে পারেন, তিনি বুঝতে পারেন, সময়ে এক অদ্ভুত জগতে তিনি এসে পৌঁছেছেন।
আর সেই সময় তিনি দেখতে পান সময় স্থির, প্রবহমান নয়। আতীত, বর্তমান সব একসঙ্গে মিশে
আছে, একই সমতলে। তিনি হয়ে ওঠেন ত্রিকালদর্শী। ত্রিকালদর্শী মানে, যিনি তিনটি কাল অর্থাৎ
অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত অবলোকন করতে পারেন।
গত বছর ডঃ ক্রিস্টি মিলার ব্যাখ্যা
করেছিলেন ব্লক ইউনিভার্স থিওরি। এখানে বলা হয়েছে আমাদের মহাবিশ্ব স্পেসটাইম একটি বিশাল চার-মাত্রিক ব্লক হতে পারে, যা সময় সম্পর্কে আমাদের মনে ঘটে যাওয়া এবং ঘটবে এমন সমস্ত ঘটনার ধারণা দেয়। ব্লক
ইউনিভার্স থিওরি বা ব্লক মহাবিশ্ব
তত্ত্বটি কিছু বৈজ্ঞানিক মহলে শাশ্বতবাদ নামেও পরিচিত, কারণ এটি বর্ণনা করে যে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত কীভাবে একসঙ্গে সহাবস্থান করে। এটি
প্রেজেন্টিজমের বিরোধী।
অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত
যদি একইভাবে বিদ্যমান থাকে, তবে প্রতিটি মুহূর্ত
আমার জন্য একটি 'এখন' মুহুর্ত হবে। এর অর্থ এইও হবে যে ভবিষ্যতে আমার মৃত হওয়া
ঠিক একইভাবে বাস্তব, ঠিক যেমন আমার বেঁচে
থাকা এখনই বাস্তব। এবং যেহেতু অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মতোই বাস্তব, তাই অতীতে বেঁচে থাকা আমার এখন বেঁচে থাকার মতোই বাস্তব।
গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বরূপ দর্শন করিয়েছিলেন অর্জুনকে। বলেছিলেন, তিনিই
সবকিছুর নিয়ন্তা। সবাই মৃত, আগে থেকেই মরে আছে, তাই কে কাকে হত্যা করবে? বাবাজী
মহারাজ গীতার বৈজ্ঞানীক দিকটি নিয়ে ভীষণভাবে অবগত ছিলেন। বুঝেছিলেন জীবাত্মা ও
পরমাত্মা আসলে Diversity in Unity or
Unity in Diversity.
তিনি বুঝেছিলেন ধ্যানের সাহায্যে অনেক অদেখা বিষয় দেখা সম্ভব, যা অলৌকিক নয়,
বরং অতি-বিজ্ঞান। মহাভারতে বিজ্ঞান সেই জায়গায় পৌঁছেছিল।
ত্রিকাল জ্ঞান মানে হল যে
তিনটি কাল যেমন বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে
জানে। এই মহাজ্ঞান বা শক্তি একটা সিদ্ধির পর পাওয়া যায়। যা সাধারণত কুন্ডোলিনী
চক্র বা শক্তি জাগরনে হয়। বিশেষ ভাবে বলা যায় আজ্ঞা চক্র জাগরণের কারনে হয়।
যদিও কুন্ডোলিনী জাগরন সবাই করতে সক্ষম হন না। কারন কর্ম ফল, অতীত জীবনের
পুণ্যের ফলে মেলে কুল কুন্ডোলিনী শক্তি জাগ্রত করার অধিকার। আজ্ঞা চক্র জাগরণের
ফলে তৃতীয় নেত্র খুলে যায়। আর এই তৃতীয় নেত্র কোন জৈবিক চক্ষু নয়। এ হলো
আত্মার চোখ। তৃতীয় নয়নকে মহাদেবের চোখ বলা হয়েছে। দেবী স্তোত্র মহা লক্ষ্মী
অষ্টোত্তর শত নামে দেখা যায় দেবাদিদেব মহাদেবকে ত্রিকালজ্ঞ বলা হয়েছে। আর এই মহাদেব
হলেন যোগীশ্রেষ্ঠ।
দেবদেব! মহাদেব! ত্রিকালজ্ঞ! মহেশ্বর!
করুণাকর দেবেশ! ভক্তানুগ্রহকারক! ||
অষ্টোত্তর শতং লক্ষ্ম্য়াঃ শ্রোতুমিচ্ছামি তত্ত্বতঃ |
কিছু কিছু মানুষ স্বপ্নে বা দিব্য দৃষ্টিতে যা দেখে তা কখনো
কখনো সত্যি হয়ে যায়। সেই সমস্ত মানুষের তৃতীয় নয়ন অল্প বিস্তর জাগ্রত হয়ে
থাকে সাধারণত পূর্ব জন্মের কৃত পুণ্যের কারনে।
আমাদের বাবাজঈ মহারাজ ছিলেন জন্ম-সন্ন্যাসী, যোগী। তিনি ধ্যানের মধ্যেই বহু সময় কাটাতেন। কিন্তু আশ্রমের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু সমস্যা তাকে যেভাবে ঘিরে ধরছিল, তিনি বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন। তাই আশ্রমে থাকতে চাইতেন না। আমাকে আশ্রমের তরফ থেকে কোন একজন বলতেন – আপনারা বাবাকে বলুন না, যেন আশ্রমে চলে আসেন তাড়াতাড়ি। বাবা জানতেন কী ঘটতে চলেছে, কী হবে? এটাই সত্য। কারণ, তিনি ছিলেন প্রকৃত সাধক, ধ্যানযোগী।