Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

Advt 720

বাবাজী মহারাজ ছিলেন এমন একজন, যার সামনে দাঁড়ালে আপনা আপনিই ভক্তিতে মাথা নত হয়ে যায়।

 


তারক ঘোষ



সন্ন্যাস নেওয়ার পর একজন সন্ন্যাসী তার পূর্বাশ্রমের সব কিছু ভুলে যান। ফেলে আসেন পিতৃদত্ত নাম, পদবী, সংসার জীবনের বন্ধন। কিন্তু আশ্রমিক জীবনে এসে তিনি লাভ করেন আর এক নাম, আর এক পদবী আর এক বন্ধনঅনেকেই প্রশ্ন করতেন, বাবা, আশ্রমও কি বন্ধন নয়? 

সন্ন্যাসীর তো বন্ধন থাকে না, থাকে না  ষড়রিপুর তাড়না, থাকে না বিলাস-ব্যসন। তাহলে? 

 আপনারা যদি শ্রীবাবাজীর জীবনের প্রতিটি কর্মে লক্ষ্য রাখেন, এর উত্তর পেয়ে যাবেন। 

শ্রীবাবাজী কোনদিন এই সংসারকেও অস্বীকার করেন নি, আবার ঈশ্বরকেও নয়। তার কাছে, জগত সত্য, ঈশ্বর সত্য। তিনি সেটা বিশ্বাস করতেন বলেন তার থিসিসে এই কথা গুলিই তুলে ধরেছিলেন। এবার, আর একবার তাকান তার কর্মের দিকে। সংসারে আমরা কর্ম করি নিজের বা পরিবারের স্বার্থে। অর্থ একটু বেশি থাকলে আর মনটা একটু প্রশস্ত থাকলে আত্মীয়দের কথাও ভাবি, বা তাদের জন্য কিছু করার কথা ভাবি। 

কিন্তু, এই সবকিছু করার পিছনে নিজের স্বার্থ জড়িয়ে থাকে, কামনা থাকে। এই কর্ম নিষ্কাম নয়। কিন্তু শ্রীবাবাজী যা করেছেন, তা দশের স্বার্থে। আশ্রম, ভক্তদের জন্য, গ্রামের রাস্তা, সব মানুষের জন্য, গ্রামে বিদ্যুত, বাড়িতে বাড়িতে শৌচাগার মানুষের জন্য, বিদ্যালয়, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। কাঠ-পুতুল শিল্পীদের লড়াকু জীবনের সঙ্গে থেকেছেন, আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, মিষ্টান্ন-শিল্পীদের পাশে থেকেছেন কেন? নিজের স্বার্থে, না কি দশের স্বার্থে?


তিনি কি কর্মের
ফলএর আশা করেছেন? করেন নি। দানের প্রতিদান আশা করেছিলেন? করেন নি। ছোট ছোট ছেলেদের মনকে পবিত্র করার জন্য গীতা পাঠ, মানুষকে জ্ঞান দিয়ে সঠিক পথে আনার জন্য প্রবচন, জ্ঞানী মানুষদের জন্য গ্রন্থ রচনা এ সবই তার নিষ্কাম কর্মের উদাহরণ। 

তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ কর্মযোগী। আর এই কর্মযোগের মাধ্যমে আমাদের শেখাতে চেয়েছিলেন, কর্ম বিনা ঈশ্বর লাভ সম্ভব নয়। আর করতে হবে সৎ কর্ম, যে কর্ম শুধু ঈশ্বরকে নয়, নিজেকেও পরিতৃপ্তি দেয়, যে কর্মের জন্য আপনি দিনের শেষে শান্তিতে ঘুমাতে পারেন সেই কর্ম।

বাবাজীর কথা যতই ভাবি, ততই অবাক হয়ে যাই। সাধু-সন্তদের চেনা জগতের বাইরে যেন উনি। তার অপরূপ জ্ঞান-চক্ষু, তার আদর্শ, তার কর্মযোগ সবকিছু যেন মনে করিয়ে দেয়, তিনি যেন আমাদের শিক্ষা দেবার জন্যই এসেছিলেন। কী করা উচিত, কী উচিত নয়, সেগুলো যেন নিজের কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তিযোগের মধ্যে দিয়ে সকলের কাছে তুলে ধরে গেছেন।

 বিগত ৯ বছর ধরে আমার মনে হয়েছে, বাবা যেন সমুদ্র-মন্থনের বিষটা নিজে পান করেছেন, অমৃত দিয়ে গেছেন আমাদের সকলকে। আমরা তাকে বুঝে উঠতে পারিনি। শিষ্যের পাপ, লোভ, বিষয়াসক্তি সব কিছু থেকে উদ্ভুত পাপকে তিনি নিজের কাঁধে নিয়েছেন। তিনি বারবার বলতেন ভগবান যাকে কাছে টানেন দুঃখের ভিতর দিয়েই কাছে টানেন। দুঃখই সুখের একমাত্র চাবিকাঠি। 

তিনি মনুষ্য জীবন, আধুনিক সাধু সমাজের একটি বিশেষ অংশকে ভালোভাবে চিনে ফেলেছিলেন। এই সাধু-সমাজেরএকাংশের ভিতরে তিনি দেখেছিলেন লোভ পদ, ক্ষমতা, অর্থ-লালসা আর ব্যক্তিপূজা। তিনি এসব কোনদিন পছন্দ করতেন না, কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাকে এসব দেখতে হয়েছিল। 


তাই বলতেন সাধুজী যদি শিষ্যদের পুজো পেতে পেতে, তাদের সারহীন স্তুতিবাক্য শুনে, নিজেকে ঈশ্বর ভেবে ফেলেন, তা সবচেয়ে ক্ষতিকর সাধকের কাছে। কারণ, মাঝখান থেকে সেই সাধক ঈশ্বরের কথাই ভুলে যান। আর একটি কথাকে তিনি খুব গুরুত্ব দিতেন। সেটি হল স্বয়ং ভগবান ভক্তির উৎপাতকে প্রশ্রয় দেন নি। ঠাকুরকে নিয়ে ও গুরুকে নিয়ে লম্ফ-ঝম্প চীৎকার চেঁচামেচি ভক্তি হতে পারে না, এটা একপ্রকার পাগলামি। 

কেন বলতেন বাবাজী একথা?  কারণ, তিনি এসব দেখেছেন। ভক্তির নামে উশৃঙ্খলতা দেখেছেন, ভক্তের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে তার অর্থ আত্মসাৎ করা দেখেছেন। সাধুর ভেক ধরে ভক্তদের ঠকাতে দেখেছেন, সমাজের বুকে ভ্রান্ত কুসংষ্কারকে চাপিয়ে দিয়ে তার থেকে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়া দেখেছেন। তাই, তিনি বাইরের ভেককে প্রাধান্য দিতেন না। 

কারণ, জটা, দাড়ি, কৌপিন বা শ্বেত/রক্তবর্ণ পোষাক কখনই সাধুর একমাত্র পরিচয় হতে পারে না। কোন বড় চোর, খুনী, ডাকাতও অনায়াসে এই বেশ ধারণ করে লোকের চোখ ও আইনের চোখকে সাময়িক ফাঁকি দিতে পারে। তাই বাবা বলতেন, বেশ দেখেই বুঝে নিবি না এদের সবাই সাধক, ঈশ্বরের সেবক।


বারবার সমাজের ভন্ডামী, চেনা কিছু মানুষের বিবেক-হীনতা তাকে কষ্ট দিয়েছে।  তাই আমাদের একবার বলেছিলেন – ‘সাধু হওয়া বড় কষ্টের।কেন বলেছিলেন?

এখন, তো একশ্রেণীর সাধুআছেন, যারা দামী গাড়িতে চড়েন, আকাশপথে যাতায়াত করেন, ধনী শিষ্যদের বাড়িতে চেলা-চামুন্ডা নিয়ে ওঠেন শিষ্যরাও তাদের ধনের গরবে অহঙ্কারী হয়ে বিশাল আয়োজন করেন, মোটা টাকা দক্ষিণা দেন। 

বাবাজী এসব মনে-প্রাণে পছন্দ করতেন না, তবু বহু ক্ষেত্রে তাকে যেতে হয়েছে এই ধরণের বহু শিষ্যের কাছে, তাদের বার বার আবেদনে। এড়াবার উপায় না থাকলে বাবা যেতেন, কিন্তু তিনি কোনদিন অর্থ স্পর্শ করতেন না। আশ্রমে দান করা অর্থ জনগণের উন্নতির জন্য ব্যয় করার নির্দেশ দিতেন। ভক্তদের দান করা অর্থ ভক্তদের কল্যাণে ব্যয় হত। 

এখন চারিদিকে তাকালে দেখতে পাই, বাবাজীর স্বপ্নের ইচ্ছাগুলোর পরিণতি কী! লোকদেখানো অনুষ্ঠান বাবা চাইতেন না, তিনি শুধু বড় বড় বুলি আওড়ানো পছন্দ করতেন না। তার ধ্যান ছিল কষ্ট থেকে মানুষের মুক্তির রাস্তা বের করা। সেটা সাধনের মাধ্যমেই হোক আর বাস্তব খারাপ অবস্থার পরিবর্তন করেই হোক। 

আমি এসব কথা লিখছি, কারণ, আমি দেখেছি, কীভাবে কী হচ্ছে। কারণ, আমি শুধু বাইরের দিকটাই দেখতাম না, গভীরে দেখতাম। বাবাজী আমার কাছে আদর্শ, আমি তার কাছে কোনদিন কিছু চাইতে পারিনি, বলতে পারিনি নিজেদের কথা। এখন বলি। এখন বলি, আপনার সবকিছু আপনি নিজে রক্ষা করুন। মানুষকে লোভের হাত থেকে রক্ষা করুন।

গুরুদেব বলেছেন, ভগবানের কাছে ক্ষণস্থায়ী জিনিস না চেয়ে ভগবানের ভক্তি চাইতে হয়। আমি ভক্তিও চাইতে পারিনিকেননা, আমার মনে হয়েছে, তাকে ভালোবাসতে পারলে, তবেই ভক্তি আসবে। সবার প্রতি ভক্তি আসে না, কেউ জোর করে ভক্তি আদায় করে। আর বাবাজী ছিলেন এমন একজন, যার সামনে দাঁড়ালে আপনা আপনিই ভক্তিতে মাথা নত হয়ে যায়।

 


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Hollywood Movies