তারক ঘোষ
দাদাজী মহারাজ তাকে কোনদিন সাধন-ভজন করতে দেখেন নি। তিনি সব সময় মদ খেতেন, কিন্তু তার কথার মধ্যে কোন জড়তা থাকত না। তিনি স্নান করতেন না, কিন্তু দেখলে মনে হতো, তিনি যেন সেইমাত্র স্নান সেরে এলেন। সন্ন্যাসীবাবার সমাধি ক্ষেত্র শিলচর শহরের বিলপার পল্লীর শ্যামানন্দ আশ্রমে।
মহাপুরুষের জন্ম হয়
না, তাদের পাঠানো হয়। বিধাতা তাদের এই ধরণীতে পাঠান বিশেষ কিছু কর্ম সাধনের জন্য,
যে কর্মের ফলে জীব ও
জগত উপকৃত হয়। তাই শতাব্দীতে হয়ত, একজন-দুজন মহাপুরুষ আসেন, বিধাতার নির্দেশে। এই মহাসাধকদের জীবনে থাকে নানা বাধা, একশ্রেণির মানুষ এদের বিরোধিতা করেন।
কিন্তু, এরা সব বিরোধিতাকে পাশ কাটিয়ে তাদের লক্ষ্যে এগয়ে চলেন।
স্বামী শ্রীশ্রী জানকীদাসজী মহারাজের
জীবনে এইরকম এক মহাপুরুষ এসেছিলেন,
যার আধ্যাত্মিক জীবন শ্রীশ্রী জানকীদাসজীকে গভীরভাবে
প্রভাবিত করেছিল।
কথিত আছে,
তার সঙ্গে যখন সন্ন্যাসীবাবার দেখা হয়, তার বয়স তখন ১৫০ বছর। অনেকেই আশ্চর্য্য
হতে পারেন,
কিন্তু এটাই সত্য। কারণ, এই সন্ন্যাসীবাবা সিপাহী বিদ্রোহের সময় পূর্ণ যুবক ছিলেন। আপনারা জানেন, সিপাহী যুদ্ধ হয় ১৮৫৭ সালে।
কিন্তু, কে এই সন্ন্যাসীবাবা? যিনি স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন দাদাজী মহারাজকে। যার সাধারণ বাহ্যিক জীবন আর আধ্যাত্মিক জীবনের মধ্যে ছিল হাজার যোজন দূরত্ব। সন্ন্যাসী বাবা অর্থাৎ শ্রীশ্রী শ্যামানন্দ গিরি ছিলেন নাটরের মহারাজার মন্ত্রী। পূর্বাশ্রমে তিনি ছিলেন চ্যাটার্জী ব্রাম্ভন। এম. এ. বি. এল. । মহারাজার নির্দেশে তাকে একটি মহল্লা দখল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, রক্তপাত তিনি পছন্দ করতেন না। তাই মহারাজার দেওয়া মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করে তিনি চলে যান হিমালয়ে। বেছে নেন আধ্যাত্ম জগতকে।
বাবাজী মহারাজের লেখা থেকে জানতে পারি
– দীর্ঘ ৪০
বছর সাধনার পর সন্ন্যাসীবাবা নেমে আসেন সমতলে। আশ্রয় নেন বানিয়াচঙ্গের সিদ্ধ পীঠস্থান মা কাত্যায়নী কালী বাড়িতে। সন্ন্যাসীবাবার সঙ্গে এখানে দেখা হল স্বামী শ্রীশ্রী জানকীদাসজী মহারাজের। এ যেন পূর্বনির্ধারিত। এটাই যেন দুই মহাপুরুষের মিলন। ঠিক
যেমন স্বামী
শ্রীশ্রী জানকীদাসজী মহারাজের সঙ্গে বড়র গ্রামে দেখা হয়েছিল স্বামী শ্রীশ্রী প্রজ্ঞাদাসজী
মহারাজের।
শ্রীশ্রী
সন্ন্যাসীবাবা তথা শ্রীশ্রী শ্যামানন্দ গিরি ছিলেন এক মহাপুরুষ। তিনি ছিলেন গিরি সম্প্রদায়ের।
থাকতেন নৌকায়। বিশাল উজ্জ্বলকান্তি। শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন। কাউকে স্পর্শ করতে দিতেন
না। কেবল স্বামী শ্রীশ্রী জানকীদাসজী মহারাজকে ভিন্ন চোখে দেখতেন। তার উপর নির্ভর করতেন।
বাবাজী
মহারাজ বলছেন – “একদিন বাবাজী মহারাজ (স্বামী শ্রীশ্রী জানকীদাসজী মহারাজ) শ্রীশ্রী সন্ন্যাসীবাবার কাছে
বসে আছেন। এই সময় সেখানে আএসেন চারজন মহিলা ভক্ত । এদের মধ্যে দুজন বৈষ্ণব, দুজন শাক্ত।
শাক্ত মহিলা ভক্ত দুজন শ্রীশ্রী সন্ন্যাসীবাবাকে প্রণাম করে বসলেন। কিন্তু, বৈষ্ণব
দুজন শ্রীশ্রী সন্ন্যাসীবাবাকে প্রণাম না করেই বসলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘আমরা
বৈষ্ণব। শাক্তকে প্রণাম করিনা।‘
শ্রীশ্রী
সন্ন্যাসীবাবা সেদিকে কান না দিয়ে শ্রীশ্রী জানকীদাসজী মহারাজকে বলতে লাগলেন –চার কোণা লণ্ঠন দেখেছিস? ওর চারটে কাঁচে যদি
লাল, নীল, সবুজ, হলুদ চার ধরণের রঙ লাগানো হয়, তবে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, শিখাটির
চার রঙ। কিন্তু, আসলে ভিতরের শিখাটির কোন রঙ নেই।‘
কী বলতে
চেয়েছিলেন শ্রীশ্রী সন্ন্যাসীবাবা? বলতে চেয়েছিলেন – আত্মা কোন সম্প্রদায়ভূক্ত নয়।
মানব দেহভেদে এই আত্মা শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যাদি পার্থন্য করে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া
করে।“
বাবা
লিখছেন, এরপর ওই বৈষ্ণবীদ্বয় শ্রীশ্রী সন্ন্যাসীবাবাকে প্রণাম করেন।
বাবাজী মহারাজের লেখা থেকে জানতে পারি - শ্রীশ্রী জানকীদাসজী মহারাজের মামার বাড়ি থেকে বানিচঙ্গের কালোবাড়ি প্রায় ১০ মেইল দূর। শ্রীশ্রী জানকীদাসজী মহারাজ স্কুলের ছুটির পর তার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। আর সন্ন্যাসীবাবাও তাকে খুব স্নেহ করতেন। শ্রীশ্রী জানকীদাসজী তার আধ্যাত্মিক জীবনের একটা বড় অংশ লাভ করেছিলেন তার কাছ থেকে। তিনি সন্ন্যাসীবাবাকে সেবা করতেন, তার থালায় প্রসাদ পেতেন। এই সন্ন্যাসীবাবাই ছিলেন তার মেন্টর, যিনি তার জীবনের প্রবাহ কোন পথে যাবে, তা স্থির করে দিয়েছিলেন।
শ্রীশ্রী জানকীদাসজী বলতেন – “এত বড় সন্ন্যাসী আমি
পাইনি। তিনি ত্রিকালজ্ঞ পুরুষ।“ সন্ন্যাসীবাবার কাছে দীক্ষা নেওয়ার ইচ্ছে ছিল শ্রীশ্রী জানকীদাসজীর। কিন্তু, সন্ন্যাসীবাবা তাকে
দীক্ষা দেন নি। বলেছিলেন, তুই তো সন্ন্যাসী। তুই তো বৈরাগী।
কিন্তু,
এসব কথা ছোট জীবেশের মনে ধরেনি। তিনি জেদ করেই বসেছিলেন সন্ন্যাসীবাবার কাছেই তাকে
দীক্ষা নিতে হবে। কিন্তু, সন্ন্যাসীবাবা জীবেশ তথা শ্রীশ্রী জানকীদাসজীর পিতা-মাতাকে বললেন –“ওকে যদি আমি মন্ত্র দিই, তাহলে ও পাগল
হয়ে যাবে। এরপর শ্রীশ্রী জানকীদাসজীর পিতা সন্ন্যাসীবাবাকে বলেন –‘জীবেশের বুদ্ধি আছে, ওকে ডাক্তারী
পড়াতে চাই।‘ শুনে সন্ন্যাসীবাবা বলেছিলেন – “কাকে ডাক্তারী পড়াবি? ও তো সাধু হয়ে চলে
যাবে।“ জানা যায়, শ্রীদাদাজী মহারাজ এরপর সন্ন্যাসীবাবার সঙ্গে দেখা করতে তার নৌকায়
যান। সেখানে সন্ন্যাসীবাবা তাকে বলেন, ‘তোর বিষ্ণু মন্ত্রে দীক্ষা হবে। তুই বৈরাগী।‘
চলবে