কারার ওই লৌহ কপাটঃ শহীদ ও বিপ্লবীদের রক্তে থাকা গানের সুর এখন বাঙালিদের ডিএনএ তে মিশে গেছে, তাকে এতো সহজে ভাঙা যাবে না।




১৯৪৯ সালে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ সিনেমায় গিরীন চক্রবর্তী 'কারার ঐ লৌহকপাট' গানের প্রচলিত সুরটি প্রয়োগ করেন। সুরটি জনমানসে সমাদৃত হয়। জহির রায়হানের 'জীবন থেকে নেয়া' সিনেমায় এই সুরটিই রাখা হয়। ইংরেজ সরকার 'ভাঙার গান' বাজেয়াপ্ত করলে মূল সুরটি হারিয়ে যায়। ইংরেজ শাসনের সমাপ্তি ঘটলে গিরীন চক্রবর্তী এতে সুরারোপ করেন। ততদিনে কবি বাকরুদ্ধ! এরপর গত ৭৪ বছরে এই সুরে আর কেউ নতুন করে হাত লাগাননি। এবার হাত লাগালেন অস্কারজয়ী এ আর রহমান।
 ভয়েস ৯ নিউজ ডেস্ক 

কাজী নজরুল ইসলামের 'ভাঙার গান' কে যে এত সহজে ভাঙা যায় না, সেটা নিশ্চয় এতদিনে এ আর কিছুটা বুঝেছেন। কারণ এ এমন এক সঙ্গীত, সুর যা ‘এয়ারে’ ভাসে না, মিশে যায় রক্ত-মজ্জা-হৃদয়ে। আর স্বাধীনতার পর এই সঙ্গীতের সুর তো বাঙালিদের ডিএনএ তে মিশে গেছে, এখান  তাকে হঠানোর সাধ্যি মনে হয় কারো হবে না। সময় তা বুঝিয়ে দেবেই। ‘নজরুলের গান সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। আর যিনি সুর বদলে নতুনভাবে তা সিনেমায় ব্যবহার করেছেন, তিনি এখনো সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন নি। দেখা যাক ৮০-৯০ বছর পর কার সুর বেঁচে থাকে!’ বললেন এক নামী সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী। 



কারার ওই লোহ কপাটকে ভেঙে ভারতকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন এই দেশের হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ। তাদের রক্তে আগুন ধরিয়েছিল নজরুলের ওই গান – তার আগুনের সুর নিয়ে। সময় বদলেছে, কিন্তু সেই সুরের রেশ আজও ভারত আর প্রতিবেশী বাংলাদেশের মানুষকে দেয় মুক্তির স্বাদ। কপিরাইট না থাকলেও কিছু নীতি থাকে, যেটা আমাদের অন্তরে থাকে, রক্তে থাকে, থাকে ইতিহাস চেতনায় আর স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপ্লবীদের জীবন দানের উদাহরণে। সেগুলো মনে না রাখলে বা ভুলে গেলে কোথাও যেন বাজে। তবে, ধন্য  বাঙালি। তারা আজও সেই মর্যাদাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। গর্জে উঠেছেন, নেট দুনিয়ায় ঝড় উঠেছে এ এর রহমানের নতুন সুরসৃষ্টির মাধ্যমে ‘কারার ওই লোহ কপাটকে’ বাজারজাত করার প্রচেষ্টায়। 



'জল ঢেলে সুরের সেই আগুনকে যে নেভানো যাবে না, সেটা সময় একসময় বুঝিয়ে দেবেই’, বললেন আর এক সঙ্গীত শিল্পী। ‘পিপ্পা’ নামের একটি হিন্দি ছবিতে এই গানটি ব্যবহার করা হয়েছে। এই সিনেমাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সদস্যকে কেন্দ্র করে সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। সিনেমাটির সংগীত পরিচালনা করেছেন অস্কারজয়ী সংগীত পরিচালক এআর রহমান। কিন্তু গানের কথা ঠিক রাখলেও গানটির আসল সুর বদল করায় এ নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে বিতর্ক শুরু হয়েছে। 
বিবিসি জানাচ্ছে -২০২১ সালে প্রযোজনা সংস্থা ও কবির পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর মধ্যে চুক্তি হয়েছিল। বিনিময়ে পরিবার দুই লক্ষ টাকা রয়্যালটিও পেয়েছিল। কবি নজরুল ইসলামের পরিবারও অভিযোগ করেছে, তাদের কাছ থেকে গান ব্যবহারের অনুমতি নেয়া হলেও যেভাবে সুর বদল করা হয়েছে, সেই অনুমতি তারা দেননি। 



এবার একটু তাকানো যাক এই গানের ইতিহাসের দিকে। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় 'বাঙ্গলার কথা' নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। এই সময় গান্ধীজীর নেতৃত্বে সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী এই আন্দোলন দমনের জন্য ব্যাপকভাবে বহু তরুণকে গ্রেফতার করা হয়। এই সময় স্বদেশী ভাবপুষ্ট লেখা প্রকাশের জন্য, ব্রিটিশ-ভারতের পুলিশ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন দাশকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেয়। এই সময় পত্রিকার হাল ধরেন তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী।
 বাসন্তী দেবী তাঁর পত্রিকায় একটি কবিতা পাঠানোর জন্য সুকুমাররঞ্জন দাশকে নজরুল ইসলামের কাছে পাঠান। সেই সূত্রে নজরুল ইসলাম এই কবিতাটি রচনা করে সুকুমাররঞ্জন দাশ-এর হাতে অর্পণ করেন। তিনি (চিত্তরঞ্জন দাশ) এই গানটি হুগলী জেলে স্বদেশী আন্দোলনের সাথে জড়িত বন্দী এবং অন্যান্য বন্দীদের সাথে গাইতেন বলে জানা যায়। অবশ্য এই কবিতার 'যত সব বন্দী-শালায়' অংশটি 'বন্দী-শালা' পড়ে বন্দীরা হট্টগোল শুরু করে। পরে অবশ্য তাঁরা তাঁদের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন।



 উল্লেখ্য, তৎকালীন ভারত সরকার গানটিকে নিষিদ্ধ করেছিল। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে নজরুলের কলম থেকে বেরিয়েছিল 'বিদ্রোহী' ছাড়া আরও একটি স্মরণীয় কবিতা - 'কামাল পাশা'। ১৯৪৯ সালে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ সিনেমায় গিরীন চক্রবর্তী 'কারার ঐ লৌহকপাট' গানের প্রচলিত সুরটি প্রয়োগ করেন। সুরটি জনমানসে সমাদৃত হয়। জহির রায়হানের 'জীবন থেকে নেয়া' সিনেমায় এই সুরটিই রাখা হয়। ইংরেজ সরকার 'ভাঙার গান' বাজেয়াপ্ত করলে মূল সুরটি হারিয়ে যায়। 

ইংরেজ শাসনের সমাপ্তি ঘটলে গিরীন চক্রবর্তী এতে সুরারোপ করেন। ততদিনে কবি বাকরুদ্ধ! এরপর গত ৭৪ বছরে এই সুরে আর কেউ নতুন করে হাত লাগাননি। এবার হাত লাগালেন অস্কারজয়ী এ আর রহমান। ১৯৪৯ সালে কলাম্বিয়া রেকর্ড এবং ১৯৫০ সালে এইচএমভিতে গিরীন চক্রবর্তীর কণ্ঠে গানটি রেকর্ড হয়। ভারত বিশেষত বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলনে এ গান ছিল প্রেরণার উৎস। এমনকি ৭০ এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও এ গান ছিল অক্সিজেন।



 • রেকর্ড: o কলাম্বিয়া [জুন ১৯৪৯ (জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩৫৬)] জি.ই. ৭৫০৬। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী।   এইচএমভি [জানুয়ারি ১৯৫০ (পৌষ-মাঘ ১৩৫৬)] এন. ৩১১৫২। 
 শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী। • চলচ্চিত্র: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন । ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ নভেম্বর (রবিবার ১১ অগ্রহায়ণ ১৩৫৬)। 
 • স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি: রশিদুন্‌ নবী। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট পঞ্চম গান। রেকর্ডে গিরীন চক্রবর্তীর গাওয়া গানের সুর অবলম্বনে কৃত স্বরলিপি। • সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম • পর্যায়: o বিষয়াঙ্গ: স্বদেশ o সুরাঙ্গ: সামরিক মার্চ o তাল: দ্রুত দাদরা o গ্রহস্বর: সা

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad