বাবাজী মহারাজ বুঝেছিলেন একমাত্র গীতার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে, ভোগবাদকে বর্জন করে কর্মময় ও ভারসাম্যের সমাজ গঠনের চাবিকাঠি

 



শ্রীমদ্ভগবত গীতা শুধু ধর্মগ্রন্থ নয় - গীতা একাধারে বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, দর্শন, অন্যদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের মূল প্রেরণা ছিল তিলকের গীতারহস্য এবং বিবেকানন্দের কর্মযোগ। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর দুচোখ আর গীতাই ছিল সেই বিপ্লবীদের তীব্র মানসিক শক্তির আধার। কারণ, গীতা দুর্বলের সান্ত্বনা নয়। গীতা শক্তিশালীর প্রেরণা। গীতা দুর্বলতা পরিত্যাগ করে নির্ভয়ে কর্মে প্রবৃত্ত হওয়ার উপদেশ দেয়। আর সে কারণেই বিপ্লবীরা তাদের কর্ম করে গিয়েছেন, স্বাধীনতার  জন্য জীবন বিসর্জন দিতেও বুক কাঁপেনি তাদের। পিছপা হননি স্বাধীনতার শতবর্ষের লড়াই থেকে। আর আধুনিক অতি-ভোগবাদী সমাজে ভোগবাদ, পাপের সাগর আর নিরাশায় ডুবে যাওয়া মানুষের জীবনে একমাত্র গীতাই হয়ে উঠতে পারে সঠিক ওষুধ। আমাদের বাবাজী মহারাজ সেটা বুঝেই শুরু করেছিলেন এক নতুন সমাজ গঠনের প্রাথমিক ধাপ। তাই তার রচিত গীতার টীকায়  যোগ করেছিলেন বর্তমান সময়কালের সমস্যা ও তা থেকে পরিত্রাণের নানা পথ।  

 

তারক ঘোষ

আপনারা সবাই জানেন, বাবাজী মহারাজ ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভোরবেলায় আশ্রমে ডেকে তাদের গীতাপাঠ করাতেন, গীতার সহজ স্রল ব্যাখ্যা করে তাদের বুঝিয়ে দিতেন। তাদের মধ্যে সৃষ্টি করতেন গীতাপাঠের নিয়মিত অভ্যাস। কিন্তু কেন? যেখানে এই আধুনিক সমাজ-ব্যবস্থায় বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা, এমনকি তাদের পিতা-মাতারা পর্যন্ত গীতা-মহাভারত-উপনিষদ থেকে শত যোজন দূরে অবস্থান করেন, গীতা পাঠকে যেখানে প্রাচীন মানসিকতা বলে উপহাস করা হয়, সেই সময় আমাদের বাবাজী মহারাজ আবির্ভূত হলেন এক নতুন সংকল্প নিয়ে – কী সেই সংকল্প?

নতুন সমাজ, ভারসাম্যের সমাজ গঠনের সংকল্প। আর সেই সমাজ গঠনের প্রাথমিক ধাপ হিসাবে এক সুস্থ সংসার গঠনের জন্য মানুষ তৈরির দিকে মন দিলেন। তিনি বুঝেছিলেন চরম ভোগবাদ মানুষকে নৈরাশ্যের দিকে ঠেলে দেয়। লোভ আর বিত্তবাসনা কোনদিন শেষ হয় না, বরং তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েই চলে। লোভের পথ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে আনতে পারে একমাত্র ত্যাগের বাসনা। আর এই ত্যাগের বাসনা তখনই মানুষের হৃদয়ে জন্মাতে পারে, যখন মানুষ তার লক্ষ্যকে চিনতে পারে। নিজেকে জানতে পারে।



আমরা জানি, সমাজ ও ব্যক্তির বিপরীতমুখী চাহিদা ও স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে সমাজের ভারসাম্য রক্ষার যে প্রচেষ্টা তারই নাম ধর্ম। এই ধর্ম যখন বিঘ্নিত হয়, অর্থাৎ ব্যক্তি ও সমাজের স্বার্থের মধ্যে যখন ভারসাম্যের অভাব ঘটে তখনই সমাজে এক শ্রেণির মানুষ সমাজের বাকি অংশের তুলনায় অধিক ক্ষমতাশালী হয়ে সমাজজীবনের স্বাভাবিক প্রবাহকে বিপন্ন করে। আর সেই বিপন্ন সময়ে এই ধরণীতে আবর্ভূত হন সমাজপুরুষরা। শ্রীশ্রী স্বামী ডক্টর প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া মহারাজ হলেন সেই সমাজপুরুষ, যিনি সমাজের সংষ্কারের মধ্য দিয়ে, ধর্মের মধ্যেও এক নতুন ধারার সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। আজ তিনি দেহে না থাকলেও, তার গবেষণা ভবিষ্যত সমাজ গঠনের এক স্বর্ণ চাবিকাঠি হয়ে আছে।

আপনারা যদি এরকম ভাবেন যে, পাশ্চাত্ত্য দর্শন কেবল ভোগের শিক্ষা দেয় এবং হিন্দু শাস্ত্র কেবল ত্যাগের শিক্ষা দেয়, তাহলে কিছুটা ভুল হবে। বহু ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দর্শন শাস্ত্রে ইহজীবনে ত্যাগ ও সংযমের উপদেশ আছে। কিন্তু, পাশ্চাত্য দর্শনে বলা হয়েছে ইহজীবনের ত্যাগ ও সংযমের দ্বারা মৃত্যুর পরে পরলোকে অনন্ত ও অসীম ভোগ লাভ করা যায়। অন্যদিকে ইহজীবন বা পরলোকেও ভোগ কখনওই জীবনের প্রধান লক্ষ্য হতে পারে না। কারণ, ভোগ প্রকারান্তরে এক প্রকার দুঃখ। সেজন্য ভোগলিপ্সাকে জয়  করতে পারলেই আসল আনন্দের আস্বাদন করা সম্ভব।

তাই, হিন্দু শাস্ত্র ত্যাগ ও সংযম পূর্বক ভোগের উপদেশ দিয়ে থাকেন। চিত্তশুদ্ধিই মুক্তির পথ। শুদ্ধচিত্ত জীবই কেবলমাত্র ভোগবাসনা থেকে মুক্তিলাভ করতে পারেন। সেজন্য শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় কর্মযোগের উপদেশই প্রধান। কর্মযোগ হল নিঃস্বার্থ ভাবে শাস্ত্রোপদিষ্ট কার্যে নিজেকে সমর্পণ। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই যে ভোগ হয় সেই ভোগ একপ্রকার যজ্ঞস্বরূপ। (দ্র. গীতা ৪/২৬)

এখন দেখা যাক,স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কী ধরণের আদর্শ সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন?

এক সমাজে প্রতিটি মানুষের  আলাদা আলাদা চাহিদা অনুযায়ী পরিপোষণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলা বাস্তবে অসম্ভব। তাই শ্রীভগবান বিধান দিলেন– “গুণঅনুযায়ী শ্রেণীবদ্ধকরণের এবং কর্মঅনুযায়ী সামাজিক অবস্থান নির্ণয়ের।

যে ব্যক্তির মধ্যে সাত্ত্বিক প্রবণতা বেশি সেই ব্যক্তি ব্রাহ্মণ, যার মধ্যে রাজসিক প্রবণতা বিদ্যমান সে হল ক্ষত্রিয়, যার ভেতর রাজসিক ও তামসিক মিশ্র স্বভাব উপস্থিত সে বৈশ্য, আর যে মানুষ নিতান্ত জড় প্রকৃতির, সর্বদা আলস্যভাব যার মধ্যে, সেই তমোগুণাশ্রিত মানুষ হল শুদ্র। এখানে উল্লেখ্য যে এই শ্রেণি নির্ণয়ের ব্যাপারে জন্ম বা বংশপরিচয়ের কোন ভূমিকা নেই।




গীতা-প্রদর্শিত সমাজব্যবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তি তার অন্তর্নিহিত স্বাভাবিক প্রবণতা অনুযায়ী সমাজে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়ে নিজেকে সেইরূপ সমাজোপযোগী কর্মে নিয়োজিত করলেই সমাজের মঙ্গল এবং ব্যক্তি জীবনে সফলতা আসবে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় গীতার দর্শন আগাগোড়া সমাজতান্ত্রিক’, কেননা এতে প্রতিটি মানুষের কর্মের অধিকার’ (Right to Work) স্বীকৃত হয়েছে। আবার অন্যদিকে গীতার দর্শন ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী’, কারণ এই সমাজদর্শনে ব্যক্তির অধিকারেরও নিজস্ব ইচ্ছা ও প্রবণতার স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে।  দুই বিপরীতমুখী আদর্শের সামঞ্জস্যবিধান করতে গিয়ে দার্শনিক শ্রীকৃষ্ণ দুটি মূলনীতির আশ্রয় নিয়েছেন
১ম নীতিসমাজ ব্যক্তিকে তার জন্মগত গুণ ও কর্মপ্রবণতার প্রতি লক্ষ্য না রেখে যে কোন কর্মে প্রবৃত্ত করতে পারবে না। ২য় নীতি ব্যক্তি নিজের জন্মগতগুণ ও কর্মপ্রবণতার বিকাশ না ঘটিয়ে মর্জিমাফিক সমাজে যে কোন বৃত্তি (Social Role) গ্রহণ করতে পারবে না।

 

চলবে...

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad