বাবাজী মহারাজ বলেছিলেন – আমরা মুখে বলি, এটা আমার নয়, তোমার – কিন্তু, বাস্তবে সেটাকে নিজের বলেই শক্ত করে আঁকড়ে রাখি



মুখে আমরা কতো কথা বলি। আমাদের মনে হয়, তোমার উদ্দেশ্যে আমার দ্রব্য উৎসর্গ করতে হলে আমার অপচয় হবে। কিন্তু, আমরা বুঝি না, তোমাকে কিছু দিলে সেটা আমাকেই দেওয়া হয়। এই বোধটাও আমাদের নেই। - বাবাজী মহারাজ

 

তারক ঘোষ


বাবাজী মহারাজ ছিলেন সাক্ষাত চৈতন্যস্বরূপ – তার সেই রূপ প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য কার বা কাদের হয়েছে আমি জানি না, তবে এটুকু জানি, যদি বাবাজী মহারাজের আসল রূপ কেউ বুঝতে পেরে থাকেন, তিনি পরম সৌভাগ্যবান। তিনি সকল বন্ধনে আবদ্ধ থেকেও মুক্ত। বাবা, এই মুক্তি পথের সন্ধানে ছিলেন, তবে বন্ধন ছিন্ন করে যে মুক্তি, সেই মুক্তি নয়। বরং নিজে মুক্ত হয়ে জনকল্যাণে নিজেকে হাজার বাঁধনে বাঁধতে পেরেছিলেন। কবিগুরু যাকে বলেছিলেন – ‘অসংখ্য বন্ধন মাঝে লভিব মুক্তির স্বাদ।‘

শৈশব থেকেই বাবাজীর মনে জন্মলাভ করেছিল বৈরাগ্যের বীজ। সেই বীজ শ্রীশ্রীজানকীদাসজীর সাহচর্য্যে অঙ্কুরিত ও বিকশিত হয়েছিল। শ্রীগুরু তাকে দিয়েছিলেন মুক্তি পথের সন্ধান। তাই হাজারো মান-অপমান-প্রবঞ্চনা তাকে স্পর্শ করতে পারে নি। তিনি অনেক কিছু দেখেছিলেন, বুঝতে পেরেছিলেন, বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে তার কিছু ভুল রয়ে গেছে। তিনি বুঝেছিলেন- মানুষের মনে যে পরিবর্তন তিনি আনতে চেয়েছিলেন, সেই পরিবর্তন তিনি আনতে পারেন নি। সমাজ সংষ্কারের আগে  সমাজের  ছোট্ট ইউনিট মানুষ, তার সংষ্কারের প্রয়োজন। বুঝে ছিলেন, চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু, মানুষ তাকে ধর্মীয় গণ্ডীর মধ্যেই রেখে দিতে চেয়েছিল। তার মুক্ত মনের, মুক্ত সমাজ ও মুক্ত ধর্ম চিন্তার দোসর তারা হতে পারেনি, কিংবা চায় নি।  আমার মনে হয় চায় নি, কেননা, গুরুভক্তি অতি কঠিন বিষয়।



মুখে ‘দেব-দিচ্ছি’ করলেও, দেওয়ার সময় সাধারণ মানুষ হাজার চিন্তা করে। গুরুকে দেওয়া যে নিজেকেই দেওয়া সেই সত্যটাও তারা বুঝতে পারে না, কিংবা সেই বোধ এর জন্মই হয় না তাদের অন্তরে। কদিন আগে বৃন্দাবনের এক সাধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল- তিনি বললেন, এখন বহু সাধুও গুরুবাক্য প্রচার ছেড়ে আত্মপ্রচারে মন দিয়েছে। ফলে, যা হবার তাই হচ্ছে, তাদের নেওয়ার ভান্ডার পূর্ণ হলেও, দেওয়ার ভান্ডার একেবারেই খালি হয়ে গেছে।

বাবাজী মহারাজের আর এক প্রম ভক্তের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি এই বাংলা থেকে অনেক দূরে থাকেন। কেন তাকে পরম ভক্ত বললাম, তার পিছনে আছে তার গুরুভক্তির জ্বলন্ত প্রমান – তিনি সবকিছুতে লিপ্ত থেকেও মুক্ত। সব কর্তব্য করেও, তিনি গুরুচিন্তা করেন, তার আদর্শে অবিচল থেকে সব কাজ সমাধা করেন পরম নিষ্ঠায়। একসময়, তিনি সাধু হতে চেয়েছিলেন, সন্ন্যাস নিতে চেয়েছিলেন। বাবা দেন নি। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সংসার জীবনে। কিন্তু সংসারে থেকেও, তিনি এখন অন্তরে সন্ন্যাসী। তার সঙ্গে যখন কথা বলি – অনেক কিছু বুঝতে পারি। বুঝি, সত্যি সাধু হতে হলে, অন্তরে সাধু হতে হয়, বাহ্যিক সাধু হলেও, তাকে অন্তরে বৈরাগী হতে হবে, নইলে সবটাই ভড়ং – অভিনয়। শুধু পোশাকটাই থাকবে, আর কিছু নয়।


দাদাজী মহারাজের চরণধন্য খড়ম

আর একজনের কথা বলতেই হয়। সে এখন কিশোর। বাবাজী মহারাজই তার নামকরণ করেছিলেন। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। সে যেখানেই বাবাজী মহারাজ সংক্রান্ত লেখা পায়, পড়ে। বাবা-মাকে পড়ে শোনায়, বা তাদের দেখায়। বাবা-মাও বাবাজী মহারাজের আশ্রিত, ভক্ত। কিন্তু, সেই কিশোর বাবাজী মহারাজকে সেরকমভাবে কাছে না পেলেও, তার আদর্শে উদ্ভাসিত। খুব ভালো লাগে, এই প্রজন্মের বহু তরুণ-তরুণরাও বাবাজী মহারাজের আদর্শকে মানে। আর এর কারণ, তাদের পিতা-মাতার নির্বিচার ভক্তি।

নিজে বন্ধনে আবদ্ধ থেকে কাউকে যেমন মুক্তির উপায় বলা সম্ভব নয়, তেমনই সম্ভব নয় নিঃষ্কাম কর্মে ব্রতী হওয়া  গৃহী বা সন্ন্যাসী যারা আত্মদর্শন বা ঈশ্বরকে জানার জন্য ব্যাকুল সকলের ক্ষেত্রেই এই কথাগুলো প্রযোজ্য হতে পারে নিজেরআমিকে চিনতে পারলে, তবেই শুরু করা যেতে পারে পরমাত্মার খোঁ আমাদের বাবাজী মহারাজ তাই বারে বারে বলতেন, অন্তরকে পরিষ্কার কর, সেখানেই যে বসে আছেন আমাদের ঈশ্বর কীভাবে আমাদের মনোভূমি প্রস্তুত হবে ভগবানের তথা পরমাত্মার জন্য, কীরকম হবে সেই মনোমন্দির, তাও বাবাজী মহারাজ বলেছেন আসলে, তিনি এসেছিলেন এই জগতের মানুষের সামনে এক নতুন দরজা খুলে দিতে, যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করা যায় পরমাত্মার খাস তালুকে অধ্যাত্ববাদী বা ধার্মিক হওয়া সোজা বিষয় নয় মন্দিরে বসে হাজার সাধন ভজন করলেও তার দেখা মেলে না, যদি না আমরা নিজেদের সবকিছুএক্সপেক্টেশনবিসর্জন দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে তার সঙ্গে লীন হতে পারি




আমার বলে কিছু থাকবে না, এই বোধটাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন- বলতেন বাবাজী মহারাজ সব কাজই করতে হয় তার কর্ম বলে যে কর্ম মানুষকে, প্রকৃতিকে, জীব-জন্তুদের কষ্ট দেয়, সেই কর্ম ঈশ্বরের কর্ম নয় যতই দুঃষ্কর্ম করে আমরা সেই কর্মকে ঈশ্বরের করানো বলে প্রচার করিনা কেন

বাবাজী বলেছেন – “আমরা মুখে বলি, এটা আমার নয়, তোমার – কিন্তু, বাস্তবে সেটাকে নিজের বলেই শক্ত করে আঁকড়ে রাখি। জন্ম-জন্মান্তরের  শতশত সংষ্কারের কালিতে কলঙ্কিত পাপপূণ্যের মলিন বস্ত্র পরিহিত সংসার জর্জরিত এই জীর্ণ শীর্ণ নোংরা আমিত্বটাকে ধরে থাকতে চাই। কী এক তীব্র মায়া এই আমিত্বটাকে। দিতে গিয়েও দিতে পারি না।“


বাবাজী মহারাজ ও তার প্রথম সাধুশিষ্য শ্রীবিষ্ণুদাসজী

বাবাজী মহারাজ বলছেন –“দিতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু দিতে গিয়েও, আবার ফিরে আসি। অকপট প্রাণে তোমার চরণে নিবেদন করতে পারি না। এত সংকীর্ণ আমরা। এত ক্ষুদ্র গণ্ডির ভিতরে আমাদের অবস্থান। শ্রী ভগবান বলছেন – মন এবং বুদ্ধি সমর্পণ করার আগে যে অতিস্থুল বস্তু দিয়ে শুরু করতে হয় – সেই শুরুটা করতেও আমাদের অনীহা। কিন্তু মুখে আমরা কতো কথা বলি। আমাদের মনে হয়, তোমার উদ্দেশ্যে আমার দ্রব্য উৎসর্গ করতে হলে আমার অপচয় হবে। কিন্তু, আমরা বুঝি না, তোমাকে কিছু দিলে সেটা আমাকেই দেওয়া হয়। এই বোধটাও আমাদের হয় নি।“  

বাবাজী মহারাজ তাই বলছেন – আমার ‘আমিটাই’ তুমি। আর এই তুমিটাই হলেন শ্রীগুরু- ভগবান-পরমাত্মা। 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad