বহু বছর আগে বাবাজী মহারাজ মজার ছলে শিষ্য-ভক্তদের উদ্দেশ্যে যা বলেছিলেন, সময় আজ তাকে চরম সত্যে প্রমানিত করেছে



ভাবছি, দেখছে কে? কেউ দেখছে না, না ভগবান, না শ্রীগুরু। দেখছে, আ্মাদের মনের মধ্যে সেট করা সিসিটিভি ক্যামেরা – জন্মের সময় থেকে যে আমাদের নিত্যসঙ্গী, এমনকি রাতের অন্ধকারেও - সব রেকর্ড রাখছে। যখন সেই একই ব্যবহার অন্যের কাছ থেকে ফিরে পাবেন, আপনি হোন, বা আমি- ফুটেজগুলো শুধু রিওয়াইন্ড করে মিলিয়ে নেবেন।

 

তারক ঘোষ

 

বাবাজী মহারাজ বলেছিলেন – “আপনারা সবাই শুনবেন আমার কথা, কিন্তু বাইরে গিয়ে কেউ মানবেন না। এটাই সবচেয়ে আশ্চর্য্যের কথা।“  বহু বছর আগে বাবাজী মহারাজ মজার ছলে এই কথাগুলো বললেও, তিনি ভবিষ্যতটা আগেই দেখে ফেলেছিলেন। কারণ, তিনি ছিলেন একদিকে ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরষ, অন্যদিকে মানব-চরিত্র সম্পর্কে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। তাই বুঝে গিয়েছিলেন, তিনি যখন থাকবেন না, তখন কী কী হতে পারে। তবু, চেষ্টা করেছিলেন ভক্তরা যাতে শ্মশান-বৈরাগ্য কাটিয়ে সত্য চেতনার আলোয় উদ্ভাসিত হন, সত্যের আলোকে তাদের জীবনটা গড়ে নিতে পারেন। কিন্তু, যারা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে সাধনের জন্য গুরুকরণ করেন, বা গুরুর কাছে যান, তারা যে কখনোই পার্থিব সুখ, কামনা-বাসনা ছাড়তে পারবেন না, সেটা বাবাজী মহারাজ বুঝে ফেলেছিলেন।



কারণ, প্রকৃত ভক্তরা শুধু গুরুকেই চান, তার চরণ-তল, তার জ্ঞানই একমাত্র কাম্য তাদের কাছে। বাকি বিষয়টা শ্রীগুরুই করেন, তাকে আলাদাভাবে বলার দরকার থাকে না। কারণ, সদগুরু শিষ্যের সমস্ত ভারই বহন করে নেন, যদি ভক্ত তার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন করেন। দূর্ভাগ্য সেই ভক্তদের, যারা নিজেদের গুরু-চরণে নিবেদন না করে, নিজেদের অসুবিধা-জ্বালা-যন্ত্রণার সাংসারিক দিকগুলো তুলে ধরে্ন, নিজেরা কীভাবে লাভবান হবেন, সেই পথের খোঁজ করতে যান শ্রীগুরুর কাছে। বোঝেন না, তারা সংসারে যে কষ্ট-জ্বালা ভোগ করছেন, সবই তাদের কর্মের প্রতিফলন, হয় ইহজন্মের, নয়তো পূর্বজন্মের। আর এভাবেই তাদের পাপক্ষয় হচ্ছে। যদি, তারা নিজেদের সংশোধিত না করেন, তাহলে পপক্ষয় হওয়া দূরের কথা, পাপের বোঝা উলটে বেড়ে যাবে।



খালি চোখে পাপ দেখা যায় না, কিন্তু সংসারের মধ্যে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমি যদি অন্যায়ভাবে কারোর ক্ষতি করি, বা করারা চেষ্টা করি, আমার ক্ষতি একসময় হবেই, হয় আমার নিজের, বা পরিবারের অন্যদের। সময়, আমাদের সব ফিরিয়ে দেবে। কটূ বাক্য প্রয়োগ, লোভের বশবর্তী হয়ে অন্যায় করা, অন্যের অহেতুক নিন্দা করা, গুরুজনদের অসম্মান – সব আমরা ফিরে পাবো। আমরা নিজেই বলি – ভগবান যা করেন, ভালোর জন্যই করেন, কিন্তু, একটু খারাপ লাগলেই, আমরা ভগবানকে দোষ দিতে ছাড়ি না।

এইধরণে মানুষদের পরিবর্রন করা খুবই দুঃসাধ্য। বাবাজীও চেষ্টা করেছিএলন, কিন্তু শেষপর্যন্ত বলতে বাধ্য হন – সবাই শোনাউল্লা। শুনতে সবাই পারে্ন। ভক্তিতে গদগদ হয়ে, কিন্তু কাজে পালন করার সময় হিসেব-নিকেশ করতে শুরু করে দেন। এরা সেই পরিযায়ী পাখির মতো। ধর্মেও আছেন, জিরাফেও আছেন। সাইবেরিয়াতে আছে, আবার ঠাণ্ডা পড়লে সাঁতরাগাছির ঝিলেও আছে। ধর্মও করবো, অন্যায়ও করবো, তারপর মন্দিরে গিয়ে, আশ্রমে গিয়ে ঈশ্বরের কাছে, শ্রীগুরুর কাছে গিয়ে জানতে চাইবো – কেন আমার এই অবস্থা হলো?



এই অবস্থায় যাত্র পড়তে না হয়, বাবা তাই আগেই সাবধান করতেন। কিন্তু, মায়ায় আটকে থাকা এই মানুষজন, বাবার কথাকে নিছকই উপদেশ ভেবে গেছেন, পালন করার কথা ভাবেন নি। ভেবে নিয়েছেন শ্রীগুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছি, শ্রীগুরুই সব করে দেবেন। হয় না, গুরুবাক্য যে মানে না, শোনে না, পালন করে না, সে পরোক্ষে নিজগুরুকেই অসম্মান করেন। তিনি আবার শিষ্য কীসের? গুরুর কাছে যারা স্বার্থসিদ্ধির জন্য যান, আর গুরুর আদর্শ মানেন না, তারা নিজেরাই নিজেদের পাপের পুকুর কাটেন বলেই আমার বিশ্বাস। মানতে হলে মানবেন, নাহলে মানবেন না। এটা আমার চাপিয়ে দেওয়া নয়। একান্তই আমার নিজের বিশ্বাস। আর বাবাজী মহারাজ ফিরে আসবেন আবার, আজ না হোক আগামি কোন বছরে, ভিন্নরূপে। তার অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য।

নিজে এক পা এগোলে, তবেই না ভগবান দু’পা এগিয়ে আসবেন! নিজে পাপের পথে চলবো, আর তার ফলভোগ করবো না, তাই কি হয় না কি? পার্থিবও আইনও, সেটাই বলে, তাই না? তফাৎ, পার্থিব আইনে সব কিছু ক্রিমিন্যাল অফেন্স নয়, কিন্তু ঈশ্বরের আইনে, পাপ পাপই, দেখা না গেলেও। আর এই পাপ, তার বাপকেও ছাড়ে না।



আমি আত্মসমালোচনার জন্য এই কথাগুলো বলছি। সময় বলে দিচ্ছে, আমরা অনেকেই সরে গেছি বাবার আদর্শ থেকে। দীক্ষা নেওয়ার সময়, বাবাজীর প্রবচন শোনার সময় আমাদের মতো ভক্ত আর হয় না, কিন্তু বাবাজীর কাজ করতে হলে আমাদের সময় নেই। জপ করার সময় নেই, বাবার কথা অন্যদের বলার সময় নেই। জীবনটাকে শোধরাবার সময় নেই। মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার ইচ্ছে নেই। লোভের মিষ্টতা ত্যাগ করার বাসনা নেই। ভাবছি, দেখছে কে?

কেউ দেখছে না, না ভগবান, না শ্রীগুরু। দেখছে, আ্মাদের মনের মধ্যে সেট করা সিসিটিভি ক্যামেরা – জন্মের সময় থেকে যে আমাদের নিত্যসঙ্গী, এমনকি রাতের অন্ধকারেও - সব রেকর্ড রাখছে। যখন সেই একই ব্যবহার অন্যের কাছ থেকে ফিরে পাবেন, আপনি হোন, বা আমি- ফুটেজগুলো শুধু রিওয়াইন্ড করে মিলিয়ে নেবেন।

 

 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad