Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

Advt 720

জাতের নামে বজ্জাতিঃ আপনি দেবতার সেবার জন্য যে চামর, ঘন্টা, প্রদীপ ব্যবহার করছেন বা যে নৈবেদ্য দিচ্ছেন, সেগুলি কোন ধর্মের মানুষের বানানো?

 



ধর্ম কাউকে খারাপ বানায় না, মানুষ নিজে খারাপ হয়। আর এর জন্য, ধর্ম বা জাত দিয়ে কাউকে দাগিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়। ঈশ্বর মানুষকে জাতের ছাপ্পা দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠান নি, মানুষ নিজে এর সৃষ্টিকর্তা।

তারক ঘোষ


বেশ কয়েকমাস আগে আমাকে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেছিলেন শ্রীরাধা-কৃষ্ণ সংক্রান্ত গবেষণা প্রসঙ্গে আমাদের হিন্দু ধর্মের গবেষকদের সঙ্গে সঙ্গে কেন বিদেশী অর্থাৎ আমেরিকান বা ইংরেজ গবেষকদের কথা তুলেছেন? তারা হিন্দু ধর্ম প্রসঙ্গে কতটা জানেন? তাকে বিনীতভাবে বলেছিলাম – গবেষকদের কোনো জাত বা দেশ হয় না, ধর্ম হয় না। যদি তাই হতো, তাহলে আপনি  দৈনন্দিন ব্যবহৃত কোনো জিনিষই ব্যবহার করতে পারতেন না। সেটা বিদ্যুৎ হোক, বা বৈদ্যুতিক সামগ্রী, টিভি হোক বা মোবাইল বা ওষুধপত্র।  এর সবই বিদেশী গবেষকদের দান, গবেষদের সাধনার ফসল। আমাদের বাবাজী মহারাজ তাই এই সমস্ত গবেষকদের সাধক আখ্যা দিতে পিছপা হননি। আমাদের স্বভাব এমন, নিজেরাও করবো না, আর অন্যে সেই কাজটা করতে এলে, তার অন্যায়, যুক্তিহীন সমালোচনা করবো।

আচ্ছা, আপনি দেবতার সেবার জন্য যে চামর, ঘন্টা, প্রদীপ ব্যবহার করছেন বা যে নৈবেদ্য দিচ্ছেন, সেগুলি কোন ধর্মের মানুষের বানানো? সেগুলো যে অন্য ধর্মের মানুষদের বানানো নয়, সেটা আপনি নিশ্চিতভাবে জানেন না। ভগবান আমাদের সৃষ্টিকর্তা – এই জীব ও জগতের, তিনি বিভাজন করে কাউকে আলো-বাতাস কম দেন নি। তাহলে, আমরা কে বিভাজন করার??? বরং, যারা এই প্রকৃতির বাতাসকে দূষিত করছেন, তারাই একসময় একটু অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করছেন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে।

আসলে, আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা এঁড়ে তর্ক করতে ভালোবাসেন। যুক্তি মানেন না, লুকিয়ে খারাপ কাজ করে ‘নামাবলী’ গায়ে দিয়ে সাধু সাজার চেষ্টা করেন। এইসমস্ত মানুষরাই সমাজকে যুগে যুগে বিপথে নিয়ে গেছেন, মানুষের সঙ্গে মানুষের লড়াই বাঁধিয়েছেন আর সেই সুযোগে নিজের ফয়দা তুলেছেন। আমাদের সমাজে এই ধরণের মানুষের সংখ্যা আবার বাড়তে শুরু করেছে, যারা ধর্মের অপব্যাখ্যা করে, গুরুতে গুরুতে বিভেদ সৃষ্টি করে, কুসংষ্কারকে জিইয়ে রেখে নিজেদের ‘ব্যবসা’ বাড়িয়েছেন।

আচ্ছা, আর একটা প্রশ্ন? আমরা কি সত্যি এগিয়েছি? আমরা কি সত্যি বিশ্বাস করি, সব মানুষের রক্তই লাল? আমরা কি জানি বা মানি, সব মানুষের সুখ-দুঃখ একইরকম? ভাষা ভিন্ন হলেও তারা কি আলাদা? ধর্ম ভিন্ন হলেই কি তারা অন্য ধর্মের মানুষের কাছে শত্রু?



আমি জানি, আমরা যতই গলা উঁচিয়ে দাবি করি না কেন, আমরা সব জাত-পাতের উর্ধে, তবুও সংশয় যায় না আমাদের মন থেকে। তাই ব্রাম্ভণ মানুষদের একটা বিরাট অংশ আজও প্রণম্য ভিন্ন ধর্মের মানুষকে প্রণাম করেন না। এখনো বহু হিন্দু বাড়িতে মুসলমান শ্রমিকদের জন্য আলাদা থালা, গ্লাস ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। আজও হিন্দু উচ্চজাতের মানুষ নিম্ন বর্ণের মানুষদের নীচু নজরে দেখে। এমনকি, অনেককে বলতে শুনেছি, ওতো তিলি, ও মাহিশ্য – ওদের কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো ব্যবহার কি পাওয়া যায়? যেন, উচ্চ জাত হলেই, সে অন্যায় করতে পারে না, এরকম ভাব। আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতের শহরে, গ্রামে এইরকম চলছে। ধর্মের নামে মানুষকে উঁচু-নীচু বিচার করা হচ্ছে।



আসলে, সব ধর্মেই ভালো মানুষও আছেন, খারাপও আছেন। যারা কোনো ধর্ম মানেন না, বা নাস্তিক, তাদের মধ্যেও খারাপ-ভালো আছেন। কাজেই, ধর্ম কাউকে খারাপ বানায় না, মানুষ নিজে খারাপ হয়। আর এর জন্য, ধর্ম বা জাত দিয়ে কাউকে দাগিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়। ঈশ্বর মানুষকে জাতের ছাপ্পা দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠান নি, মানুষ নিজে এর সৃষ্টিকর্তা। নিজেদের স্বার্থে তাই এটাকে আজও জিইয়ে রেখেছে। আর এর সুযোগ নিচ্ছেন বেশ কিছু ধান্দাবাজ মানুষ।

 ধর্মের নামে ভয় দেখিয়ে আজ ২০২৪ সালের মুখেও মানুষকে বোকা বানিয়ে রেখেছে। নিজদের ‘ধর্মগুরু’ সাজিয়ে কিছু ধান্দাবাজ মানুষ (এরা সমাজের একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ) ফায়দা তুলছেন, আশ্রম বানাচ্ছেন, ব্যাঙ্কে টাকার পাহাড় গড়ছেন। আর মুখে বলছেন, ‘ত্যাগই মহান ব্রত’। কী ত্যাগ করলেন এরা? নাম? আবার তো নতুন নামে আধার-কার্ড, ব্যাঙ্কের একাউন্ট খুলতে হচ্ছে, পাসপোর্ট বানাতে হচ্ছে। তাহলে কী হলো। ‘আমি’ টা তো রয়েই গেল, অন্য নামের আড়ালে। সবাই তো আর আসল সন্ন্যাসী নন, যে আমিত্বের অহঙ্কার বিসর্জন দেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখবেন? এরা জন্ম সন্ন্যাসী। সূযোগ-সন্ন্যাসী নন।



কতিপয় আশ্রমে, যেখানে রাধা-কৃষ্ণের পুজো হয়, সেখানেও খোঁজা হয় ব্রাম্ভণ পূজারী। অব্রাম্ভণদের খুব একটা এই অধিকার দেওয়া হয় না। অথচ, ব্রাম্ভণ্য ধর্মের প্রাবল্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যই বৈষ্ণব ধর্মের আবির্ভাব। বৈষ্ণব দর্শনের মূল কথা হল আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন বৈষ্ণব হচ্ছে ভগবানের নিত্য দাস। আর এই জীবের স্বরূপ হচ্ছে এই ভগবানের নিত্য দাসত্ব লাভ করা—‘‘জীবের স্বরূপ হয় কৃষ্ণের নিত্য দাস’’—কৃষ্ণের তঠস্থা শক্তির ভেদাভেদ প্রকাশ

 আজ আমরা সেকথা ভুলে গেছি। বহু রাধা-কৃষ্ণ পূজিত আশ্রমে এরকম নিয়ম আছে, ওই আশ্রমের মহন্ত হতে হলে, তার প্রথম শর্ত তাকে ব্রাম্ভণ হতে হবে, যদি ব্রাম্ভণ না পাওয়া যায়, তবে সুযোগ্য কোন অব্রাম্ভণকে মোহন্ত করা যেতে পারে। পরে, ব্রাম্ভণ পাওয়া গেলে, আগের মোহন্তকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে।

আমাদের বাবাজী মহারাজ কোনোদিন জাত-পাতের এই যুক্তিহীন তর্কের মধ্যে থাকতেন না। তার কাছে সব ধর্মই সমান মর্যাদা পেত। আর এটা তার শুধু বিশ্বাসের মধ্যেই ছিল না, কর্মের মাধ্যমে এটাকে প্রমান করে দিয়ে গেছেন। আসলে, প্রকৃত শিক্ষাই মুক্তি দেখায়, বিভাজনের আড়ালে যে ধান্দা আছে সেটাকে চিনিয়ে দেয়। সমস্যা কিছু অর্ধ-জ্ঞানের মানুষকে নিয়ে, যারা না জানেন বিজ্ঞান, না জানে্ন ভারতীয় সংষ্কৃতি, না জানেন ধর্মের অর্থ, না আছে সঠিক পড়াশোনা, আর নিজেকে সবজান্তা মনে করা। এই মানুষগুলোই ধর্মকে নিয়ে ব্যবসা করে, বিভাজন করে, মানুষের মধ্যে লড়াই লাগায়। এরা আজও আছে, আমাদের চারপাশে। এদের সংশোধিত করা যায় না, কারণ এরা নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই সবকিছুকে ব্যবহার করে। এরা জ্ঞানপাপী।



বাবাজী মহারাজ এই ‘জাতের নামে বজ্জাতির’ বিরুদ্ধে বারবার প্রতিবাদ করেছেন। কখনো মহানামব্রত মঞ্চ থেকে, কখনো কুম্ভ মেলায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে, কখনো প্রবচনে। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, এই সনাতন ধর্মের ব্যপ্তি, সহনশীলতা নিয়ে। তিনি বলেছেন সনাতন ধর্ম কখনো অন্য ধর্মকে হিংসা করতে শেখায় না। তিনি বলেছেন, এই ধর্ম কখনো অন্য গুরুদেবদের অশ্রদ্ধা করতে শেখায় না। পাশাপাশি, এটাও বলেছেন – প্রকৃত গুরু চিনতে হয়, নইলে ঠকতে হয়। অনেকে ভক্তদের পুজো পেতে পেতে নিজেদের ভগবান সাজিয়ে ফেলেছেন। এদের থেকে দূরে থাকতে হয়।

বাবাজী মহারাজ বলেছিলেন -‘আমাদের আশ্রমগুলি যেন যথার্থ অর্থেই ভজন সাধনের তথা লোককল্যাণের ্ররতথা শাস্ত্র প্রচারের কেন্দ্রে পরিণ হয়। যেখানে একদিকে ত্যাগবতী সাধুদের জীবন-দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে উদভ্রান্ত যুবক শ্রেণি, অপরদিকে সীতা-সাবিত্রী, লোপামুদ্রা, মৈত্রেয়ী প্রভৃতি নারীদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের নারী সমাজ নতুন করে আত্মমূল্যায়ন করবে এবং এদের হাত ধরে নতুন ভারত গড়ে উঠবে।

 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Hollywood Movies