গুরুদেব দেহে না থাকলেও, তার প্রতি যিনি সেবা–জ্ঞানে কর্তব্য ও তার রেখে যাওয়া আদর্শ পালন করেন ও সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেন তিনিই শিষ্য

 


তারক ঘোষ


সদ্গুরুর মুখনিঃসৃত বাক্য হল শাস্ত্রের সার ও মন্ত্রতুল্য। গুরুবাদ হল অধ্যাত্ম সাধনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। গুরুসেবা হলো শ্রেষ্ঠ পূজা। গুরুর মূর্তি-ধ্যান হলো শ্রেষ্ঠ ধ্যান। গুরুর বাক্য হলো শ্রেষ্ঠ মন্ত্র। গুরুর জ্ঞান বা তত্ত্বজ্ঞান হলো শ্রেষ্ঠ জ্ঞান। গুরুর কৃপা হলো শ্রেষ্ঠ কৃপা।

 

মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব হালিশহরে গুরু ঈশ্বর পুরীর কাছে গেলেন। কিন্তু, তিনি তখন গত হয়েছেন। কিন্তু, গুরু দেহে থাকুন বা না থাকুন মহাপ্রভু সেখানকার মাটি আঁচলে বেঁধে নিয়ে এসেছিলেন।  আচার্য শংকর অদ্বৈতবাদী ছিলেন; বুও তার গুরুর প্রতি নিষ্ঠা আজও সকলে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। আমাদের বাবাজী মহারাজও ছিলেন গুরু-অন্ত-প্রাণ এক শিষ্য। সারাটা জীবন তিনি তার মধ্যে শিষ্যভাবই বজায় রেখেছিলেন। শুধু ধর্মীয় গুরুদেবকে নয়, তার শিক্ষাগুরুকেও সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতেন। আর ধর্ম এটাই আমাদের শেখায়। আর এইসবই তো শিক্ষণীয়। আর এখন, সকলেই গুরু হতে চায়, শিষ্য হতে কেউ চায় না। 

যে গুরুই হোক না কেনো, এমনকি বিদ্যালয়ের গুরুও গুরুপদবাচ্য। কোনো গুরুরই দোষ দর্শন করতে নেই। সমস্ত বস্তুর মধ্যে গুরুকে দর্শন করার অর্থ ব্রহ্মদর্শন। রহ্মদর্শন ও গুরুদর্শন একই কথা। একজন জল চায়, আরেকজন বলে water দাও। অর্থ কিন্তু একই।

আমাদের বাবাজী মহারাজ যেখানেই যেতেন, সেখানেই তিনি তার শ্রীগুরু শ্রীশ্রী জানকীদাসজীর কথা বলতেন। এমন কোনো দিন নেই, এমন কোনো জায়গা নেই, যেদিন বা যেখানে তিনি দাদাজী মহারাজের প্রসংগ তোলেন নি। আর আমরা? ভেবে দেখুন, দীক্ষা নেওয়ার সময় বা তার পরে যেভাবে জপ-তপ, গুরু-কথা বলা - সবকিছু পালন করতাম, আজ করি?




সাধারণ মানুষদের মতোই মহামানবদের জীবনের লীলা শেষ হয় ঠিকই, কিন্তু তাদের আর পাঁচটা মানুষের মতো পরিসমাপ্তি ঘটে না। তারা বেঁচে থাকেন তাদের রেখে যাওয়া গৌরবময় কর্মের মধ্যে, তাদের দর্শন আর সৃষ্টির মধ্যে। 

আমাদের বাবাজী মহারাজও তাই রয়ে গেছেন আমাদের মাঝেই। কিন্তু, তার এই থাকা, আর না থাকা, এটা একেকজন ভক্তের কাছে এক একরকম। কেউ ভাবেন, বাবাজী নেই, তারা শোক করেন। তার মৃত্যুতিথি পালন করেন। আবার কেউ মনে করেন, তিনি আছেন সবসময়। তারা শোক করেন না, শুধু একমনে তার রেখে যাওয়া আদর্শকে অনুসরণ করে চলেন। 

একথা সত্যি, আমাদের বাবা আমাদের দেখছেন – আমদের প্রতিটি কাজ একবার তিনি যার দায়িত্ব নিয়েছেন, তাকে তিনি ছাড়েন না। যেমন আমরা সিসিটিভি সারভিলেন্সের মধ্যে থাকি, ঠিক সেইরকমই গুরুদেবের অনির্বা নজরে আছি।


আমার মতে
, আমরা যদি তাকে মনে রাখি, তার দেখানো পথ অনুসরণ করি, তাহলে তিনি আছেন। তার মৃত্যু নেই। তিনি অমর। পৃথিবীর নিয়মে পার্থিব শরীর ছাড়লেও, তিনি রয়ে গেছেন এই পৃথিবীর গাছে-পাতায়-জীবনের রঙে। তিনি বেদনায় থাকেন না, তিনি আনন্দস্বরূপ।

বাবাজী তার সাধু-শিষ্য ও গৃহী-শিষ্যদের জন্য অনেক কিছু রেখে গেছেন। আমি পার্থিব সম্পদের কথা বলছি না। যে সম্পদ অক্ষয়-অমর-যা দান করলে বাড়ে সেই সম্পদের কথাই বলছি। সেটা হলো জ্ঞান, চেতনা। নিজেদের চিনে নেওয়ার মন্ত্র। 

বাবাজী মহারাজ বলতেন, নেতাজী, স্বামীজী, এপিজে আব্দুল কালাম, বালগঙ্গাধর তিলকের জীবন ও বাণী মানুষকে পথ দেখাতে পারে। তারা যে আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, আমরা কোথাও না কোথাও সেই আদর্শ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আর এই দূরে সরতে সরতে আমরা চলে যাচ্ছি ঈশ্বরের কাছ থেকে, মুক্তি থেকে অনেক দূরে।

আমাদের বাবাজী মহারাজ ছিলেন প্রকৃত সন্ন্যাসী। তাই তার মধ্যে কেউ কখনো ‘আমি বলছি’, ‘আমি আশীর্বাদ করছি’ – একথা কোনোদিন শোনেন নি। এখন দেখা যাক,  সন্ন্যাসী কে? আর ‘আমিত্ব’ই বা কী?



আমি এবং আমার সব স্মৃতি - যার মন থেকে  মুছে গেছে, তিনিই চির সন্ন্যাসী। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের গলার ক্যান্সার ছিল। গুরুর শারীরিক অবস্থার জন্য স্বামী বিবেকানন্দ খুব দুঃখ পেতেন। তিনি একবার শ্রীরামকৃষ্ণকে বলেছিলেন, গুরুদেব, আপনি নিজেই যোগী। আপনি নিজের ধ্যানের দ্বারা গলার ক্যান্সার নিরাময় করছেন না কেন ? তখন ঠাকুরজী বললেন, আমার মন মা জগদম্বাতে স্থির। মনকে ওখান থেকে সরিয়ে শরীরে লাগাবো কেন, যখন কোনো না কোনো সময় এই শরীর ছেড়ে চলে যেতে হবে।

এই প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ ও এক শিষ্যের কথোপকথন শুনে নিন।

স্বামীজী যতক্ষণ আমিজ্ঞান আছে, ততক্ষণ সত্য। আর যখনই আমি আত্মা’ — এই অনুভব, তখনই এই ব্যবহারিক সত্তা মিথ্যা। লোকে যে পাপ পাপবলে, সেটা weakness (দুর্বলতা)-এর ফলে — ‘আমি দেহএই অহং-ভাবেরই রূপান্তর। যখন আমি আত্মা’ — এই ভাবে মন নিশ্চল হবে, তখন তুই পাপপুণ্য ধর্মাধর্মের অতীত হয়ে যাবি। ঠাকুর বলতেন, ‘আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল।

শিষ্য মহাশয়, ‘আমি’-টা যে মরিয়াও মরে না! এইটাকে মারা বড় কঠিন।

স্বামীজী এক ভাবে খুব কঠিন, আবার আর এক ভাবে খুব সোজা। আমিজিনিষটা কোথায় আছে, বুঝিয়ে দিতে পারিস? যে জিনিষটে নেই, তাকে নিয়ে আবার মারামারি কি? আমিত্ব-রূপ একটা মিথ্যা ভাবে মানুষ hypnotised (সম্মোহিত) হয়ে আছে মাত্র। ঐ ভূতটা ছাড়লেই সব স্বপ্ন ভেঙে যায় ও দেখা যায় এক আত্মা আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত সকলের মধ্যে রয়েছেন। এইটি জানতে হবে, প্রত্যক্ষ করতে হবে। যত কিছু সাধনভজন এ আবরণটা কাটাবার জন্য। ওটা গেলেই চিৎ-সূর্য নিজের প্রভায় নিজে জ্বলছে দেখতে পাবি। কারণ, আত্মাই একমাত্র স্বয়ংজ্যোতিঃ স্বসংবেদ্য।

মনে রাখতে হবে – শ্রীকৃষ্ণে সবকিছু সমর্পণ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দেওয়া বিধি নির্দেশ পালন করে চলাই ভক্তি। আর বিধি-নির্দেশ না মেনে 'আমি ভগবান মানি', 'ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কে বিশ্বাস করি', 'ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমার প্রিয় প্রভু',- এসব কথা বলে কোনো লাভ হয় না। এগুলো তার প্রতি ভক্তি বা বিশ্বাসের লক্ষণ নয়।



দেহরোগের ওষুধ মেলে ডাক্তারের কাছে এবং ভবরোগের ওষুধ মেলে মহাত্মা মহাপুরুষদের কাছে। সদ্গুরুর মুখনিঃসৃত বাক্য হল শাস্ত্রের সার ও মন্ত্রতুল্য। গুরুবাদ হল অধ্যাত্ম সাধনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। গুরুসেবা হলো শ্রেষ্ঠ পূজা। গুরুর মূর্তি-ধ্যান হলো শ্রেষ্ঠ ধ্যান। গুরুর বাক্য হলো শ্রেষ্ঠ মন্ত্র। গুরুর জ্ঞান বা তত্ত্বজ্ঞান হলো শ্রেষ্ঠ জ্ঞান। গুরুর কৃপা হলো শ্রেষ্ঠ কৃপা। সদ্গুরু হলেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ঘনীভূত মূর্তি এবং ব্রহ্ম আত্মার মূর্ত স্বরূপ। এই গুরুই হলেন সংসার ও অধ্যাত্মজীবনের উপায়, উপেয় এবং পরাগতি

স্বামীজী বলছেন - শিষ্যের এই গুণগুলি আবশ্যকপবিত্রতা, প্রকৃত জ্ঞানপিপাসা ও অধ্যবসায়। অশুদ্ধাত্মা পুরুষ কখনও ধার্মিক হইতে পারে না। কায়মনোবাক্যে পবিত্র না হইলে কেহ কখনও ধার্মিক হইতে পারে না। আর জ্ঞানতৃষ্ণা সম্বন্ধে বলা যাইতে পারে যে, আমরা যাহা চা, তাহাই পাইইহা একটি সনাতন নিয়ম। 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad