রাধা-কৃষ্ণের দর্শনে নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের অবদান অনস্বীকার্য, শ্রীরাধাকে এই সম্প্রদায় দেবীর গরিমা প্রদান করেন

আজ থেকে শুরু হচ্ছে ‘রাধা-কৃষ্ণ’ সম্পর্কিত আমাদের বিশেষ ধারাবাহিক প্রতিবেদন 
তারক ঘোষ 
১ম পর্ব

 রাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক গাথা, পদাবলী। লোকের মুখে মুখে সেই কাহিনী পল্লবিত হয়েছে। কখনো শ্রীরাধাকে নিছক এক পরস্ত্রী হিসাবে অন্য পুরুষের প্রণয়ে আসক্ত দেখানো হয়েছে। কোথায় শ্রীরাধাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে কৃষ্ণের আনন্দ অংশের হ্লাদিনী শক্তি হিসাবে।
 যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের ধর্মীয় ও লোক-সমাজে ব্যাখ্যাত হয়েছেন রাধা ও কৃষ্ণ। কোথাও প্রেমের উপদান হিসাবে, কোথাও ভগবানের অংশ হিসাবে রাধা-কৃষ্ণ তত্ব প্রচারিত হয়েছে। 
রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলী লিখেছেন মিথিলার কবি বিদ্যাপতি, বাংলা ভাষায় লিখেছেন বড়ু চন্ডীদাস। কবি জয়দেব ও বিদ্যাপতির পদাবলীতে কৃষ্ণলীলার যে নাগরিক পরিশীলিত রূপ দেখতে পাওয়া যায়, চন্ডীদাসের রচনায় গ্রাম্য পটভূমিকায় দেখা যায় রাধাময় রূপ। 
এরপর নানাভাবে রাধা-কৃষ্ণ ধরা দিয়েছেন। জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, শ্রীরূপ গোস্বামীসহ – অসংখ্য স্বনামধন্য পদকারের কলমে। 


প্রসঙ্গত, রাধা নামে কোন চরিত্র মহাভারত বা ভাগবত পুরাণের কোথাও পাওয়া যায় না। ভাগবত এর দশম স্কন্ধের ২৩ অধ্যায়ে রাসলীলা বর্ণিত হয়েছে। চৈতন্য সম্প্রদায়ের ভাষ্যমতে, রাধারাণীর নাম ও পরিচয়টি ভাগবত পুরাণে এই ঘটনা বর্ণনাকারী ছন্দোবন্ধে গোপন রাখা হয়েছে এবং উজাগরও করা হয়েছে। 
রাধারাণী রাসনৃত্যের অংশীভূত হওয়া সমস্ত গোপিনী তথা দিব্য ব্যক্তিত্বদের মূলসত্ত্বা। রাধা-কৃষ্ণ হল ঈশ্বরের পুরুষ সত্ত্বা ও প্রকৃতি সত্ত্বার যুগলরূপ। নিম্বার্ক ও গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মশাস্ত্রে, কৃষ্ণকে ভগবান রূপে দেখা হয় এবং রাধা হলেন কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। 
শ্রীরাধাকে দেবী হিসাবেই মানা হয়। রাধা ও কৃষ্ণের সত্তা ভিন্ন নয়। কিন্তু লীলার জন্যই তারা ভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আনন্দ স্বরূপ কৃষ্ণকে যিনি মনের মধ্যে ধারণ করে রাখেন, তিনিই রাধা। 


নিম্বার্ক মতে, রাধা বিষ্ণু-কৃষ্ণের শাশ্বত সঙ্গী। মনে রাখতে হবে, নিম্বার্কই প্রথম শ্রীরাধাকে সাহিত্যের কল্পিত অনৈতিক নিহিতার্থ থেকে রাধাকে উদ্ধার করেন এবং তাকে সেই গরিমা প্রদান করেন যা অন্য কোথাও তাকে দেওয়া হয়নি। 
রাধা-কৃষ্ণের দর্শনে নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের অবদান অস্বীকার করা যায় না, কেননা, এই দর্শন ও তত্ত্ববিদ্যা এখান থেকেই আরম্ভ হয়েছিল। এই সম্প্রদায়ে, রাধার মাহাত্ম্য শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্যের চেয়ে কম নয়। নিম্বার্কের এই ঘরানায় দুজনেই সংযুক্তভাবে আরাধনার সামগ্রী। 

"অঙ্গে তু বামে বৃষভানুজম্ মুদা বিরাজমানম্ অনুরূপসৌভাগম্। 
 সখীসহস্রেহ পরিসেবিতাম্ সদা স্মরেম্ দেবীম্ সকলেষ্টকামদাম।" 

নিম্বার্ক সম্প্রদায়ে উপাসনার একমাত্র সামগ্রী সংযুক্ত দিব্যদম্পতি রাধা-কৃষ্ণ। পঞ্চদশ শতাব্দীর জগদ্‌গুরু স্বামী শ্রী হরিব্যাস দেবাচার্য লিখেছেন -
 "রাধামকৃষ্ণস্বরূপম্ বৈ, কৃষ্ণম্ রাধাস্বরূপিনম্; কলাত্মানম্ নিকুঞ্জস্থং গুরুরূপম্ সদা ভজে" 
আমি নিরন্তর রাধার গুণগান করি যিনি কৃষ্ণ ছাড়া অন্য কেউ নন, এবং শ্রীকৃষ্ণ রাধা ছাড়া অন্য কেউ নন, যাদের সম্মিলন কামবীজ দ্বারা প্রকাশ করা হয় এবং যারা অনন্তকাল নিকুঞ্জ গোলোক বৃন্দাবনের নিবাসী। 

কথিত আছে, একবার বৈদিক পণ্ডিতরা ব্রহ্মাজীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "অনেক দেব-দেবীর মধ্যে শুধু রাধাজীকেই কেন পূজা করা হবে? এর কারণ কী? তিনি বলেছিলেন শ্রী রাধাজী সর্বোচ্চ ঐশ্বরিক শক্তি, তিনি মহাবিশ্বের সমস্ত ঐশ্বরিক শক্তির কারণ, পুষ্টিদাতা এবং রক্ষক। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাধাজীর উপাসনা করেন। এই কারণেই সর্বেশ্বরী শ্রীরাধাজীর পূজা করা হয়।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad