বাবাজী মহারাজ বড়র আশ্রম থেকে এসেছিলেন শূন্যহস্তে। অনেকে তাই বলেন। আমি বলি, না, তিনি শূন্য হস্তে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার মাথায় ছিল তার শ্রীগুরুর আশীর্বাদ। অর্থ বা পদ নিয়ে তিনি আসেননি, কিন্তু শ্রীগুরুর সবচেয়ে বড় ঐশ্বর্য তিনি লাভ করেছিলেন। আর এটাই ছিল বড় পাওয়া।
তারক ঘোষ
ভারতে প্রয়োজন শ্রীবাবাজী মহারাজের মতো উচ্চ-শিক্ষিত, কুসংষ্কারমুক্ত, বিজ্ঞানমনস্ক, জ্ঞানী সাধকের, যাদের জীবন ও কর্ম জনগণের কাছে থাকবে ত্যাগব্রতের এক উচ্চ আদর্শের উদাহরণ হিসাবে।
শ্রীগুরুর কাছ থেকে মহন্ত বা আশ্রমের উত্তরাধিকার নয়, তিনি পেয়েছিলেন জ্ঞান, সেবা ও কর্মের মন্ত্র। আর আমৃত্যু, সেই জ্ঞান ও কর্ম দিয়েই শ্রীগুরুকে ভজনা করে গেছেন, মানুষের জন্য কাজ করেছেন, গুরুসেবার মতোই।
তার মতো সন্ন্যাসী বিরল। তিনি এই ভারতের ধর্মীয় আকাশে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।
বাবাজী মহারাজ ছিলেন এমন এক সন্ন্যাসী, যিনি বুঝেছিলেন, ইন্টারনেটের যুগে একটা বড় ভূমিকা নেবে ডিজিটাল মিডিয়া। ডিজিটাল মিডিয়ার হাত ধরেই তার শ্রীগুরু সহ নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের পরম্পরা ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বজুড়ে।
সদগুরুদাসজী লিখেছেন –“নতু্নগ্রামে আসবার কিছুদিন পর থেকেই তিনি ইন্টারনেটে Voice of an Indian Sage নামে পরম্পরার কথা ছড়িয়ে দেবার কাজ শুরু করেছিলেন।“
মিডিয়াকে বাবাজী মহারাজ মনে করতেন এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, যারা পারে সত্য খবরের মাধ্যমে সঠিক জনমত গঠন করতে। তাই তিনি মিডিয়ার কাছে আবেদন করেছিলেন, তারা এগিয়ে আসুক এক সুস্থ সমাজ গড়ার উপযুক্ত পরিবেশ গঠনে।
আমি বাবাজীর গুরুভক্তির কয়েকটা কথা তুলে ধরি সদগুরুদাসজীর লেখা বাবাজী মহারাজের জীবন-চরিত গ্রন্থ থেকে – তবে, আমি আক্ষরিকভাবে তুলে না ধরে, বিষয়টা বলি।
- একটা সময় এল, যখন দাদাজী মহারাজ অর্থাৎ স্বামী জানকীদাসজী মহারাজের পাশ ফিরে শোয়ার ক্ষমতাও চলে গেল। দাদাজী মহারাজ বাবাজীর উপর একান্তভাবেই নির্ভর করতেন। বাবাজী মহারাজ তাকে ওঠাতেন, বসাতেন, শোয়াতেন, খাওয়াতেন।
একদিন বাবাজী মহারাজ কোন কাজে বের হয়েছেন, ফিরতে দেরি হয়েছে। ফিরে এসে দেখেন, দাদাজী মহারাজের শরীরের একপাশ ফুলে গেছে। একভাবে একটানা শুয়ে থাকার জন্য। বাবাজী মহারাজের চোখ সেদিন ভিজে যায় জলে।
দাদাজী বলেন – তুই নেই, কে আমাকে সরিয়ে শোয়াবে!
আর একটি কথা।
- একদিন বাবাজী মহারাজ দাদাজী মহারাজের শরীরের দুপাশে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে উঠিয়ে বসানোর চেষ্টা করছেন।
এই দৃশ্য দেখে এক ভক্ত বাবাজীকে বললেন –‘তুমি বাবার শরীর ডিঙিয়ে দাঁড়িয়েছ, তুমি তো মহাপাপী, তোমার তো নরকেও ঠাই হবে না।‘
বাবাজী সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন - ‘আগে তো বাবা সুস্থ হোন, তারপরে না হয় নরকে যাব।‘ এটা শুধু গুরুভক্তির পরিচয় নয়, বিজ্ঞানমনষ্ক মন নিয়ে গুরু-সেবা।
ধর্মের ন্যায়-অন্যায়কে প্রাধান্য না দিয়ে তিনি শুধুকে গুরুকে একটু আরাম দেবার ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলেন।
স্বামী জানকীদাসজী তার এই জ্ঞানী শিষ্যকে ঠিকই চিনেছিলেন। আর এই শিষ্য তার শ্রীগুরুর মর্যাদাই রেখে গেছেন তার জীবন ও কর্মে।
স্বামী জানকীদাসজী তাই বলেছিলেন –“প্রজ্ঞাদাস যেভাবে আমার সেবা করছে কোন সতীসাধ্বী নারীও এভাবে পতিসেবা করতে পারবে না।“
বাবাজী মহারাজ তার শ্রীগুরুর নির্দেশিত বিষয়কেই তার গবেষণার বিষয় হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। কারণ, স্বামী জানকীদাসজী ছিলেন এক উচ্চ-শিক্ষিত, জ্ঞানী ও যুক্তিবাদী মহাপুরুষ, বাবাজী মহারাজও ছিলেন যুক্তিবাদী।
স্বামী জানকীদাস মহারাজ লিখেছেন –“আমার মতে বেদান্ত দর্শন এবং মার্কসবাদের নীতিগুলির সংমিশ্রণ মানুষকে পুরোপুরি এবং স্থায়ীভাবে সন্তুষ্ট করতে পারে। যদিও মার্কস এবং প্রথাগত চিন্তাবিদরা আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাগুলিকে দেখেন এবং মোকাবিলা করেন, তবে দুটি সিস্টেমের একটি মিশ্রণ মানুষকে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পারে। এই অবস্থায় আমি আমার শিষ্য স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, মার্কসীয় ও বেদান্ত দর্শনের ক্ষেত্রে গবেষণা করার জন্য। “
বাবাজী মহারাজ বারবার বলতেন – সমাজের প্রতি সাধু সমাজের একটা দায়িত্ব আছে, যেমন আর পাঁচটা সমাজবদ্ধ জীবের থাকে। শুধু আত্মভোগে নিমগ্ন থাকলে চলবে না। চাই আত্মচিন্তন। মানুষ শুধু নিজের জন্য বাঁচে না, এই কথাটা তিনি বারে বারে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বাবাজী মহারাজ বিতর্কে ভীষণ গুরুত্ব দিতেন।
মিডিয়ার পজিটিভ সমালোচনা নিয়ে তিনি রাগে ফেটে পড়তেন না। বরং বলতেন – সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিতর্কের প্রয়োজন আছে, তবে সেটা যেন নেগেটিভ না হয়। সমাজের ক্ষেত্রে একজন সাধকের দায়বদ্ধতা কী- এ নিয়েও বিতর্কের প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মনে করতেন।
বাবাজী মহারাজ স্বামী সন্তদাসজীর উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন – ‘সন্তদাসজী মহারাজ জোরের সঙ্গেই বলে গেছেন, একসময় নিম্বার্কের দ্বৈতাদ্বৈতবাদকেই মেনে নিতে হবে। অর্থাৎ -ব্রম্ভ সত্য, জগত সত্য। জগতকে তাচ্ছিল্য করে ধর্ম হবে না। এই দুই এর এক পরিচ্ছন্ন সংমিশ্রণ প্রয়োজন।“
সাধুর কর্তব্য কী প্রসঙ্গে বাবাজী বলেছেন –“আগে আমাদের উচিত ধ্যান-জপ করে নিজেকে ও ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা, তারপর তা জনগণের কাছে, ভক্তদের কাছে বলা।
অথচ, দেখুন, আমরা অতি সহজে গুরু হয়ে যাচ্ছি। গুরু হয়ে গেলে পুজো পাওয়া যায়। তাই আমরা অতি সহজেই গুরু হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু, এর ফলটা কী? তখন হঠাৎ হওয়া সাধুদের কথার গাম্ভীর্য থাকে না। সাধু যদি আধ্যাত্মিকতায় ধনী না হয়, তাহলে তিনি সমাজ পরিবর্তন করতে পারবে না।“
বাবাজী মহারাজ জোরের সঙ্গেই বলে গেছেন – তার প্রতিটি কর্ম তিনি করে চলেছেন শ্রীগুরুর ইচ্ছাক্রমেই।
আপনার হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন, এমন কোন সভা-সমাবেশ, অনুষ্ঠান নেই, এমন কোন পাঠচক্র নেই, এমন কোন প্রবচন নেই, যেখানে বাবাজী মহারাজ তার শ্রীগুরুর কথা বলতে ভুলে গেছেন। লক্ষ্য করে দেখবেন, তার প্রতিটি কর্মে রয়েছে স্বামী জানকীদাসজীর ভাবধারার ছাপ, তার দর্শন। স্বামী জানকীদাসজী যে নির্লোভ, সাধারণ জীবন যাপন করে গেছেন, বাবাজী মহারাজও সেই পথেই চলেছেন। দাদাজী মহারাজ যেভাবে শিষ্য-ভক্তদের দেখতেন, তাদের জন্য ভাবতেন, বাবাজী মহারাজও সেইভাবেই ভাবতেন।
বাবাজী মহারাজ বড়র আশ্রম থেকে এসেছিলেন শূন্যহস্তে। অনেকে তাই বলেন। আমি বলি, না, তিনি শূন্য হস্তে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার মাথায় ছিল তার শ্রীগুরুর আশীর্বাদ। অর্থ বা পদ নিয়ে তিনি আসেননি, কিন্তু শ্রীগুরুর সবচেয়ে বড় ঐশ্বর্য তিনি লাভ করেছিলেন। আর এটাই ছিল বড় পাওয়া।