সেই ‘ম্যাজিক সার্কেল’ আজও আমাদের ঘিরে রেখেছে। ধর্ম, শিক্ষা, বিজ্ঞান-মনষ্কতা আর পিতার স্নেহে, তিনি আমাদের ঘিরে রেখেছেন। আমাদের চেতনার গভীরে তিনি আজও আমাদের ঘুম ভাঙানোর কাজ করে চলেছেন। তিনি আমাদের কাছে এক অগ্রদূত। তার প্রয়াণ তিথিতে পুর্ব-বর্ধমানের নতুনগ্রামে তার প্রতিষ্ঠিত শ্রীগুরুর নামাঙ্কিত তপোবন আশ্রমে অনুষ্ঠিত হয় গীতাযজ্ঞ। আসেন সাধু-সন্ত ও ভক্ত-শিষ্যরা।
তারক ঘোষ
যে দিনটি আমাদের চেতনার গভীরে ভয়ঙ্করভাবে আঘাত করেছিল, সেই দিনটি অর্থাৎ ২৮ ফেব্রুয়ারী আগতপ্রায়। এই দিনটিতে আমরা বাবাজী মহারাজের পার্থিব শরীরকে হারিয়েছি। কিন্তু, ২০১৪ থেকে ২০২৩ এ এসে উপলব্ধি করেছি – সময় এই মহান সন্ন্যাসীর কাছে পরাভূত – মৃত্যু, জীবনের পরিণতি হলেও, মৃত্যুই শেষ কথা বলে না। যিনি বিশ্ব-ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথের একজন বিমুগ্ধ পাঠক ছিলেন, তিনি যেন সেই দিন বলে গেলেন –
‘আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়’ এই শেষ কথা বলে
যাব আমি চলে।"
তিনি মৃতুঞ্জয়, তাই আজও বেঁচে আছেন আমাদের মাঝেই। তিনি আমাদের বদ্ধ মনে বন্দী থাকা চেতনাকে দিয়েছিলেন মুক্তির পথ। তিনি ছিলেন চির-আনন্দ। তার প্রয়াণ দিবস তাই পালিত হোক ‘চেতনা দিবস’ হিসাবে।
এই কর্মযোগী, বিজ্ঞানমনষ্ক, সমাজসংষ্কারক, সাধকের তিরোধান দিবসকে ‘চেতনা দিবস’ হিসাবে পালিত হোক- এই দাবি আমার একার নয়। এই দাবি তার অসংখ্য গৃহি ভক্তদের। যারা আজও বাবাজী মহারাজকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসেন।
প্রতিদিন তার শ্রীচরণে প্রার্থনা জানান।
সদগুরুদাসজীর লেখা শ্রীবাবাজী মহারাজের জীবন চরিত থেকে আমি দুটো তথ্য পাচ্ছি। প্রথমতঃ ২৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৪, বাবাজী মহারাজ বৃন্দাবন থেকে নতুনগ্রামে এসেছিলেন।
আর একটি তথ্য – এই তারিখেই আমাদের বাবাজী মহারাজ বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন, মাঝে ব্যবধান ছিল ২০ বছরের।
আর এই মাঝের ২০ টি বছর, তার প্রতিটি কাজের মাধ্যমে আমাদের জড় চেতনাকে জাগ্রত করার অবিরত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াবাবাজী মহারাজ। তিনি ছিলেন জ্ঞানের সেবক, চেতনার বাহ্যিক রূপ আর গুরুভক্তির একটা জীবন্ত উদাহরণ।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব বাংলার নবজাগরণে জ্বালিয়েছিল এক আগুনের শিখা। তার লোকশিক্ষা মানুষকে পরিশোধিত হবার রাস্তা দেখিয়েছিল। তার ভক্ত বীর-সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ, তার দেখানো পথকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন জ্ঞানের আলোয়; ঠিক তেমনি স্বামী জানকীদাসজী মহারাজও এসেছিলেন লোকশিক্ষা দেওয়ার জন্য।
এই যোগীশ্রেষ্ঠ সাধক নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের পূর্বতন সন্ন্যাসীদের আদর্শকে মাথায় রেখে, প্রয়োজনে নিজস্ব চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য। আর তার মহাপ্রয়াণের পর তার আর এক সুযোগ্য শিষ্য স্বামী প্রজ্ঞাদাসজী মহারাজ, তার জ্বালিয়ে যাওয়া মশালের আলোয় আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
তার চলা থেমে গেছে, কিন্তু পথ যেমন শেষ হয়নি, তেমনি শেষ হয়ে যায়নি তার আদর্শ। তার জ্ঞান তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন, তার ভক্ত-শিষ্যদের মাঝে। কেউ না কেউ, আবার হাতে তুলে নেবে সেই চেতনার মশাল, আবার জ্বলে উঠবে আলো, আবার শুরু হবে তার দেখানো পথে চলা।
কিন্তু, শ্রীবাবাজীকে বুঝতে হলে, চেতনার ঘুম ভাঙাতেই হবে। চেতনাই পারে মানুষকে সঠিক পথে চালাতে। আজ মনে পড়ছে গান্ধীজীর অকালপ্রয়াণের পর লেখিকা নয়নতারা সেহগালের লেখা কয়েকটি কথা –
“I felt the magic circle had vanished, leaving me unprotected.”
বাংলা অর্থ – আমি অনুভব করলাম, আমাকে অরক্ষিত রেখে সেই যাদু-বলয়টা হারিয়ে গেল।“
কিন্তু, তারপর তিনি লিখছেন –
“What if now Bapu is gone. We were still there, young, strong and proud to bear his banner before us.”
এখন যদিও বাপুজী চলে গেছেন, কিন্তু আমরা আছি এখনো, যুবক-যুবতী, সামর্থ্যবান, গর্বিত; তার ধ্বজা বহন করার জন্য।“
সেই ‘ম্যাজিক সার্কেল’ আজও আমাদের ঘিরে রেখেছে। ধর্ম, শিক্ষা, বিজ্ঞান-মনষ্কতা আর পিতার স্নেহে, তিনি আমাদের ঘিরে রেখেছেন। আমাদের চেতনার গভীরে তিনি আজও আমাদের ঘুম ভাঙানোর কাজ করে চলেছেন। তিনি আমাদের কাছে এক মসীহা, অগ্রদূত।
বাবাজী একজায়গায় তার শ্রীগুরু প্রসঙ্গে বলছেন –
“যে কোন কাজ তিনি ধরতেন, তা শেষ না করে ছাড়তেন না। এটা ছিল তার বাহ্য ব্যবহার। লোকচক্ষুর আড়ালে কতভাবে কত ভক্ত শিষ্যের অধ্যাত্ম উন্নয়ন ত্বরাণ্বিত করতেন, তার সব খবর কারো জানা নেই।“
আমরাও জানিনা, আমাদের বাবাজী কীভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে কত মানুষের উপকার করে গেছেন। আর এই উপকার শুধু আধ্যাত্মিক দিকে নয়, তার সামাজিক ও ব্যক্তিগত উপকার।
বাবাজী মহারাজ জড়বাদকে কোনদিন প্রাধান্য দিতেন না।
তিনি লিখছেন –“নির্গুণ অদ্বৈতবাদ, আমাদের শান্তি দিতে পারে নি। মস্তিষ্কের চাহিদা মেটাতে গিয়ে হৃদয় শূন্য হয়ে গেছে। ছেড়া কাথায় শুয়ে বছরের পর বছর সন্তান উতপাদন করেছি। সেই সন্তানকে মানুষ করতে না পেরে অদৃষ্টের দোহাই দিয়েছি। এই পরিস্থিতে বিবেকানন্দ এসে বলেছিলেন –‘তোরা গীতাপাঠ বাদ দিয়ে ফুটবল খেলগে যা।‘ নেতাজী বলেছিলেন ‘মনসা পুজোয় সাপ মরবে না। সাপ মারার জন্য ঘরে লাঠি রাখতে হবে।“
বাবাজী মহারাজ বলছেন ‘ক্ষুদ্র আমি’ কে বৃহৎ আমি’তে পরিণত করতে পারলে, তবেই নিজেকে শুদ্ধরূপে দেখা সম্ভব।
তখন শোক থাকবে না, শত্রু থাকবে না, কারোও দোষ চোখে পড়বে না। হৃদয়ে প্রেম এলেই চিত্ত হিংসা, বিদ্বেষের উপরে উঠতে পারে।
আজ এই প্রেমের অভাব, তাই মানবতার মৃত্যু হচ্ছে এখানে সেখানে। স্বামী স্ত্রীকে হত্যা করছে; স্ত্রী হত্যা করছে স্বামীকে। সন্তান পিতা-মাতাকে, পিতা-মাতা সন্তানকে। নারীদের উপর অত্যাচার চলছে, আবার নারীকে পুজোও করা হচ্ছে।
এই অনাচার আজ সর্বত্র। আর এর জন্যই প্রয়োজন চেতনার বিকাশ। আর সেই চেতনার বিকাশের জন্য শোনা দরকার বাবাজীর বাণী।
তাই শ্রীবাবাজীর মহাপ্রয়াণ দিবস হোক ‘চেতনা-দিবস’।
কবিগুরুর কথায় –
“ভাবের লালিত ক্রোড়ে না রাখি নিলীন
কর্মক্ষেত্রে করি দাও সক্ষম স্বাধীন।“