এখন এই জগতে নিত্য মুক্ত পুরুষ নারদজীর কথা বলেছি, এখন ওনার সমন্ধে একটু জানা যাক।
পুরাণ মতে নারদজী এই সংসারে প্রথমে বদ্ধ জীব হয়ে জন্ম গ্রহন করেন। পরে ব্রহ্মার মানস পুত্র চতুর্সনকাদির অন্যতম ঋষি শ্রী সনত্ কুমারের শিষ্যত্ব গ্রহন করেছিলেন।
এরপর শ্রী গুরুদেবের আশীর্বাদে ' ভূমাতত্ব ' বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে দেহ মুক্ত হয়েছিলেন। সেই নারদ ঋষি আবার নিত্য লীলায় ব্রহ্মজ্ঞান ও অন্যান্য উপদেশ দেবার জন্য অর্থাৎ শ্রীগুরুদেব রূপে এই সংসারে নিজেকে প্রকটিত করেছিলেন।
ওনার উল্লেখযোগ্য শিষ্য হলেন বালক ধ্রুব, নিযমানন্দ স্বামী বা নিম্বার্ক মুনি ও আরও অনেকে। এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য হল ধ্রুবজী বা নিম্বার্ক মুনির জন্মকাল কিন্তু ভিন্ন সমযে অর্থাত বিভিন্ন সমযে প্রকটিত হযে গুরুদেব রূপে বা গুরুশক্তির প্রকাশ ওনার মধ্যে দেখা গিয়েছিল।
এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে শ্রীকৃষ্ণ অবতার রূপে মনুষ্য জীবন ধারণ করে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন কিন্তু নিত্য মুক্ত পুরুষ নারদজী অবস্থান কাল অল্প সময়ের জন্য বা জগত কল্যাণের জন্য ওনার প্রকাশ কিন্তু ভিন্ন ধরনের।
তৃতীয়তঃ -- প্রাচীন সম্প্রদায় বা পরম্পরার গুরুদেব রূপে। ওনারা এই জগত সংসারে মানুষের শরীর ধারণ করে মানব কল্যাণের জন্য অবতীর্ণ হন।
ভারতবর্ষে এরকম প্রাচীন সম্প্রদায় বা পরম্পরা অনেক আছে কিন্তু এই আলোচনা সীমিত থাকবে নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের মধ্যে।
শ্রী নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের গুরুদেবরা কিভাবে এই জগতের মনুষ্য শরীর গ্রহণ করে মানব কল্যাণের জন্য বা ত্রিতাপ জ্বালায জর্জরিত মানবকুলকে পরিত্রাণ করার নিমিত্ত বা কিভাবে সাধারণ মানুষকে পরমার্থের সন্ধান দেওয়ার যায় - তারজন্য কিরূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন -
প্রথমতঃ - শ্রী ভগবানের অংশ রূপে।
দ্বিতীয়তঃ - বিদেহী মুক্ত আত্মা রূপে।
তৃতীয়তঃ - জীবন্মুক্ত আত্মা রূপে।
এখন এই সমন্ধে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
পুরাণ মতে একদা এই পূণ্যভূমি ভারতবর্ষে তমোগুণের দ্বারা আবিষ্ট হয়ে মানবজাতি ধর্মহীন ও নাস্তিক পরিণত হয়েছিল এবং এই জগতে ত্রিতাপের জ্বালায় জর্জরিত হয়ে সংসারে দগ্ধ হয়ে পড়েছিল।
তাই এই সংসারে মানুষের উদ্ধারের পথ বা পরমার্থের সন্ধান কিভাবে উন্মোচন করা যায় এবং ধর্মপথ প্রতিষ্ঠা করা যায এই উদ্দেশ্যে নারদ ঋষি ও অন্যান্য দেবতারা গোলকবিহারীজীর কাছে প্রার্থনা জানিয়ে স্তব করেন।
স্তবে সন্তুষ্ট হযে শ্রী ভগবান নির্দেশ দিয়েছিলেন -
' অজ্ঞানতিমিরান্ধানাম্ বিষ্ণুমার্গং প্রদর্শয় '। ( ভবিষ্য পুরাণ)
অর্থাৎ এই মানবলোকে অবতীর্ণ হয়ে মানবজাতির কল্যাণে অজ্ঞান ও অন্ধকারে নিমজ্জিত ও ধর্মপথে দগ্ধ ভ্রান্ত মানবজাতিকে বিষ্ণুর পথ প্রদর্শন কর।
তখন ওনার অংশ থেকে গোদাবরীর তীরে তৈলঙ্গ দেশে বৈদুর্য্য পত্তন নামক গ্রামে অরুণ ঋষি ও জয়ন্তী দেবীর গর্ভে এক সন্তান জন্ম গ্রহন করলে তাঁর নামকরণ হল নিযমানন্দ।
যে স্বামী নিযমানন্দের কথা বলেছি , ওনাকে শ্রীনারদ ঋষি দীক্ষা ও নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচর্য প্রদান করে পূর্ণ ব্রহ্মজ্ঞান উপদেশ দিয়েছিলেন এবং সম্যগ ব্রহ্মবিদ্যার উপদেশ প্রদান করে ও তার ধারা অব্যাহত রাখার জন্য তিনি বিশেষ ভাবে নিযমানন্দের মধ্যে গুরুশক্তির সঞ্চার করেন অর্থাৎ ওনার গুরুদেব শ্রী সনত্কুমারের নিকট যে ব্রহ্মবিদ্যা প্রাপ্ত হযেছিলেন তা তিনি নিযমানন্দের মধ্যে সঞ্চার করেন। পরে উনি স্বামী নিম্বার্ক মহামুনি ও নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের মূল আচার্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
তবে শ্রী নিম্বার্ক আচার্যের পরবর্ত্তী আচার্য শ্রীনিবাসাচর্যের পর থেকে শুরু করে শ্রী দেবদাসজী মহারাজজী পর্যন্ত যে আচার্য পরম্পরার তালিকা পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় এই পরম্পরার পঞ্চাশ জন আচার্য গভীর অরণ্য বা হিমালয়ে সাধনা করতেন। তাই ওনাদের গুরুশক্তির সমন্ধে বা ওনারা কিভাবে জগত কল্যান সাধন করেছিলেন সে সমন্ধে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না।
তবে ওনাদের মধ্যে ব্যতিক্রমী ছিলেন-- শ্রীপুরুষোত্তম আচার্যজী, শ্রী কেশব কাশ্মীরী ভট্টাচার্যজী, শ্রী হরিব্যাস দেবাচার্যজী, শ্রী স্বভূরাম দেবাচার্যজী, শ্রী চতুর চিন্তামণি নাগাজী, শ্রী ইন্দ্রদাসজী মহারাজজী। ওনাদের প্রণীত যে সমস্ত গ্রন্থ এখনও পর্যন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তার থেকে প্রমাণিত হয় যে এই সমস্ত আচার্যগণের মধ্যে অগাধ পান্ডিত্য ছিল আর লৌকিক শিক্ষার প্রতি প্রগাঢ সচেতনতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
এর থেকে আর একটা বিষয় প্রমাণিত হয় যে শ্রী গুরুদেব হতে হলে শুধু আধ্যাত্মিক জ্ঞান থাকলেই চলবে না, লৌকিক শিক্ষায বিশেষ জ্ঞান থাকতে হবে বা পারদর্শী হতে হবে, তা না হলে লৌকিক জগতের কল্যাণ সাধন করা অসম্ভব হযে যাবে।
ওনাদের মধ্যে শ্রী হরিব্যাস দেবাচার্যজীর সমন্ধে আলোচনা করা যাক তাহলে নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের গুরুপরম্পরার বা গুরুশক্তির প্রকাশ সমন্ধে কিছুটা ধারনা করা যাবে।
উনি ছিলেন নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের পঞ্চত্রিশতম আচার্য। ওনার পান্ডিত্যের কথা আগেই উল্লেখ করেছি - ওনার প্রণীত অনেক গ্রন্থ আজকের দিনে সমান ভাবে সমাদৃত।