বাবাজী গীতার ব্যাখ্যা করে বলেছেন ঈশ্বরের দেওয়া জিনিষ যদি নিজেরা ইচ্ছেমতো, স্বার্থপরের মতো ভোগ করি, তবে আমরা চোর, ভগবানের রোষ তো নেমে আসবেই

চলতি বছর বুঝিয়ে দিতে চলেছে গ্রীষ্মের দহন কাকে বলে আর ভূমিকম্প কী জিনিষ! আর সেই দহন আর ভূমিকম্প হলো ঈশ্বরের বিচার। যারা আজ প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করে লোভের আগুনে নিমজ্জিত, তাদের জন্যই ঈশ্বরের বিচার নেমে আসছে ধীরে ধীরে। প্রকৃতি কখনো পুতনা, কখনো কালীয়নাগ, কখনো কংস রূপে হাজির হচ্ছে মানুষের রাজ্যে




তারক ঘোষ 


মরা এই দ্বিতীয় পর্যায়ে আলোচনা করছি বাবাজী মহারাজের কর্মযোগের সাধনা নিয়ে। কীভাবে তিনি ভেঙ্গে না পড়ে, ‘কর্ম’এর মাধ্যমে আবার শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন তার পথ চলা। কীভাবে তিনি মানুষের কাছে কর্মের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, সেসব নিয়েই আমাদের এই ফিরে দেখা। 
তিনি শুধু সমাজসংষ্কারক ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক প্রকৃতি-প্রেমী মহামানব।
 হয়তো আজ আপনাদের চোখে পড়ছে দেশে-বিদেশে বেড়ে গেছে ভূমিকম্পের ঘটনা। শুধু সিরিয়ার ভূমিকম্প আপনাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির কাছে আমরা কতটা অসহায়। এর উপর আছে, সুনামী, অগ্ন্যুৎপাত। অর্থাৎ প্রকৃতি চাইলে মানুষ তো ছাড়, এই জগতটাকেই নিমেষে ধ্বংস করে বিলীন করে দিতে পারে মহাকালের গহ্বরে। 

আর এই প্রকৃতিই হলো ঈশ্বরের আর এক রূপ। আমরা আজ সেই প্রকৃতিরূপী ঈশ্বরকেই ধ্বংস করার খেলায় মেতেছি। যার পরিণতি ভয়ঙ্কর। চলতি বছর বুঝিয়ে দিতে চলেছে গ্রীষ্মের দহন কাকে বলে। আর সেই দহন হলো ঈশ্বরের বিচার। যারা আজ প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করে লোভের আগুনে নিমজ্জিত, তাদের জন্যই ঈশ্বরের বিচার নেমে আসছে ধীরে ধীরে। প্রকৃতি কখনো পুতনা, কখনো কালীয়নাগ, কখনো কংস রূপে হাজির হচ্ছে।

বাবাজী মহারাজ তার ‘গীতা চিরন্তন’ গ্রন্থে গীতার একটি শ্লোকের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলছেন – “ঈশ্বরের দেওয়া জিনিষ যদি নিজেরা ইচ্ছেমতো, স্বার্থপরের মতো ভোগ করি, তবে আমরা চোর। আমাদের কর্তব্য ঈশ্বরের জিনিষ, ঈশ্বরকে নিবেদন করে ভোগ করা। আমাদের কর্তব্য হলো, দেবতাদের কাজে সাহায্য করা। যাতে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, জলদূষণ না হয়, তার চেষ্টা করা। আমরা অক্সিজেনের সাহায্যে বাচি, আমাদের উচিত আরো গাছ রোপন করে প্রকৃতিতে অক্সিজেন ফিরিয়ে দেওয়া।“ অর্থাৎ, ঈশ্বরের জিনিষ নিলেই হবে না, তা ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হবে, নইলে আমরা চোর প্রতিপন্ন হবো। আর চুরির সাজা তো পেতেই হবে। 
বাবাজী মহারাজ তার ব্যাখ্যায় লিখছেন –“বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে সেই জল শুদ্ধভাবে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। এইভাবে পরস্পরের দ্বারা উপকৃত হয়ে আমরা এই সংসারকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারি। আর এর জন্য প্রথম দরকার আমাদের লাগামহীন ভোগ বাসনাকে সংযত করা। 
গঙ্গা-যমুনার স্বচ্ছতা ও প্রবাহমানতা যাতে বজায় থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা। আর এটাই গঙ্গা-যমুনার পূজা। আমরা যদি এগুলো না করতে পারি, ভগবানের রোষ তো নেমে আসবেই। প্রকৃতি কখনো পুতনা, কখনো কালীয়নাগ, কখনো কংস রূপে হাজির হবে।“
বাবাজী মহারাজ গীতার ‘কর্মযোগ’ পর্যায়ে একটি শ্লোকের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলছেন – “কর্মের মাধ্যমে যজ্ঞ সম্ভব; যজ্ঞের দ্বারা বৃষ্টি হয়; বৃষ্টি থেকে অন্ন; অন্ন থেকে জীবের উতপত্তি হয়। জীব থেকে কর্ম সম্ভব হয়। কর্মের মাধ্যমে শ্রীভগবান লাভ হয়। শুধু ইন্দ্রিয় সুখের জন্য যে কর্ম করে তার জীবনকে ধিক্কার।“ বাবাজী মহারাজ বলছেন – “আমরা যা কিছুই গ্রহণ করি না কেন, তা শ্রীভগবানকে নিবেদন করে গ্রহণ করা উচিত। শ্রীভগবানকে অন্ন নিবেদন করার পর, সেই অন্ন প্রসাদে পরিণত হয়। এই প্রসাদ গ্রহণ করলে মানুষ পাপমুক্ত হয়।“ 
এই প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন –“কাঠিয়াবার আশ্রিত সাধু প্রেমদাসজী মহারাজ প্রসাদের মাহাত্ম্যকে অস্বীকার করায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। পরে এই প্রসাদ গ্রহণের মাধ্যমেই তার উন্মাদ রোগ ভালো হয়।“ সংসারী মানুষ বেশিরভাগ সকামভাবে কর্ম করেন। তাই তাদের পাপ-পূণ্য স্পর্শ করে। নিষ্কাম ব্যক্তির পাপও নাই, পূণ্যও নাই। কা্ঠিয়াবাবার কথায় –‘যিসকা ধন, উসকা পূণ্য, সাধুকা না পাপ, না পূণ্য।‘ 
মনে রাখতে হবে – ক্ষুদ্র ফলের আশায় কর্ম করলে, সে কর্মবন্ধনে বদ্ধ হয় ও সংসার স্রোতে ঘুরতে থাকে। 'বিনিময়ে কী পাব' – এই আশায় কর্ম না করে, ‘কর্মে আমার অধিকার, ফলে নয়’ – এইভাবে কর্ম করলে – সেটাই নিষ্কাম কর্ম। আপনি যদি ‘ভবিষ্যতে সন্তান আপনাকে দেখবে’ ভেবে তার পিছনে অর্থ খরচ করেন, মানুষ করেন; আর ভবিষ্যতে যদি সে না দেখে, তাহলে হা-হুতাশ করেন, তাহলে বুঝতে হবে, আপনি নিষ্কাম কর্ম করেন নি, স্বার্থ নিয়ে সন্তানকে মানুষ করতে চেয়েছিলেন।
 তাই আপনাকে সেটা ফিরে পেতেই হবে।
মনে রাখবেন, কর্মে আপনার অধিকার – অর্থাৎ সন্তানকে মানুষ করা আপনার কাজ- ফলে আপনার অধিকার নেই, অর্থাৎ, সে দেখল, কি, না দেখল, সেদিকে আপনি তাকাবেন না। এইভাবে সন্তান মানুষ করতে পারলে, সেই সন্তান অবশ্যই তার কর্তব্য করবে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। 
কারণ, মনে রাখতে হয়, আশ্রমে দান করা আপনার কর্তব্য, কিন্তু, প্রতিদান পাওয়ার আশায়, ‘ইনভেস্টমেন্ট’ হিসাবে ‘দান’ করলে, পরোক্ষে তা ক্ষতির কারণ হয়। আমি বহু ব্যবসায়ীকে দেখেছি, কীভাবে সুবিধা ভোগ করার আশায়, আশ্রমে কালো টাকা দান করেন। তারপর সেই আশ্রমের ‘সাধু’দের কন্ট্রোল করে নিজের স্বার্থ-সিদ্ধির চেষ্টা চালান। এতে শেষপর্যন্ত ক্ষতিই হয়। 
যিনি স্বার্থ নিয়ে অন্যায় অর্থ দান করেন, তার, আর যিনি সব জেনেশুনে গ্রহণ করেন, তারও।
তাই, বাবাজী বলছেন –‘কর্মে উদাসীনতাকে বৈরাগ্য বলে না। এটা অমনোযোগমাত্র। যে কর্মে মনোযোগী হতে পারে না, সে জপ-ধ্যানেও মনোযোগী হতে পারেনা। তাইতো নিষ্কাম  কর্মকে  পূজা বলা হয়েছে, সাধনা বলা হয়েছে।‘

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad