বাবাজী লিখছেন –“শ্রীজানকীদাসজী মহারাজের অপারেশনের সময় রক্ত দিয়েছিলেন তার এক গৃহী শিষ্য”

আমি এই প্রতিবেদনগুলি লেখার জন্য স্বামী সন্তদাসজী মহারাজ, স্বামী জানকীদাসজী মহারাজ, স্বামী প্রজ্ঞাদাসজী মহারাজ, স্বামী সদগুরুদাসজী, শিশির কুমার ঘোষাল, অর্চনা পুরী, জয়দোয়াল গোয়েন্দকা এর লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ, শ্রীমদ্ভগবত গীতা, গীতা চিরন্তন, শ্রী জানকীদাসজীর গীতার ব্যাখ্যা, শ্রী সন্তদাসজীর গীতার ব্যাখ্যা, আমেরিকা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন বিদেশী লেখকদের লেখা রাধা-কৃষ্ণ তত্ব, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বাবাজী মহারাজের লেখা প্রবন্ধ, সংবাদপত্রে বাবাজীর সাক্ষাৎকার, বিভিন্ন প্রবচন ভিডিও থেকে তথ্য নিয়েছি। এছাড়া, বিভিন্ন সময় বাবাজীর সঙ্গে আমার আলোচনা, অসম, বিহার, ঝাড়খন্ড, হিমাচল প্রদেশ, ত্রিপুরায় শ্রীবাবাজী মহারাজের অন্যান্য শিষ্য-ভক্তদের সঙ্গে আমার কথাবার্তা থেকেও তথ্য পেয়েছি। শ্রীবাবাজী মহারাজ, শ্রীদাদাজী মহারাজের বহু জীবিত ও প্রয়াত শিষ্য আমাকে নানাবিধ তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। আমি তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞ
জকের প্রতিবেদন লেখার আগে, একটি কথা বলে নিই, নিম্বার্ক বৈষ্ণবগণ এই বিশ্বসংসারকে অলীক ও মিথ্যা গণ্য করেন না। সবকিছুকেই ভগবানের সগুণরূপ বলে গ্রহণ করেন।
 ‘সর্বং খল্বিদং ব্রম্ভ’ – এই মহাবাক্য নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের সেবাধর্মের মূলমন্ত্র। 
 আজকের এই প্রতিবেদন শুরু করি জয়দোয়াল গোয়েন্দকারের কথা দিয়ে। জয়দোয়াল গোয়েন্দকা ছিলেন একজন গৃহী। সংসার ত্যাগ করে তিনি সাধু হয়ে যাননি। তার স্ত্রী ছিল, ব্যবসা ছিল। কিন্তু, গৃহী হয়েও তিনি সাধু হয়ে উঠেছিলেন। সাধু হিসাবেই তিনি এই জগতে পরিচিত। 
 জয়দয়াল গোয়েঙ্কা ১৯৪২ (১৮৮৫) সালে রাজস্থানের চুরুতে শ্রীখুবচন্দ্র আগরওয়ালের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তিনি গীতা ও রামচরিতমানস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। 
তিনি তার পরিবারের সাথে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এই রাজ্যের বাঁকুড়াতে চলে আসেন। বাংলায় যখন দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, তখন তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের সেবা করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। 
গীতা এবং অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থগুলি ভালভাবে অধ্যয়ন করার পরে, তিনি ধর্ম প্রচারের জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করার সংকল্প নিয়েছিলেন। তিনি কলকাতায় "গোবিন্দ ভবন" প্রতিষ্ঠা করেন। বিশুদ্ধ ভাষায় গীতা প্রকাশের লক্ষ্যে তিনি ১৯২৩ সালে গোরক্ষপুরে গীতা প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন।
তার লিখিত অসামান্য হিন্দি গ্রন্থ ‘অমৃত বাণী’ আজও মানুষকে ভুল পথ থেকে সঠিক পথে নিয়ে আসে। এই জয়দোয়াল ছিলেন অধ্যাত্ম জগতের মানুষ। নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণে এনে তিনি জয় করেছিলেন কাম-ক্রোধ-লোভ সহ সব কটি রিপুকে। আর সেই রিপুর তাড়না থেকে নিজেকে মুক্ত করে হয়ে উঠেছিলেন নিষ্কাম কর্মযোগী। 
শ্রীজানকীদাসজী তাই তার ডায়েরীতে লিখেছিলেন – সংসারটা আসলে অন্তরে, বাইরে নয়। আর যিনি মনের মধ্যে থাকা এই সংসারকে জয় করতে পেরেছেন, তিনিই সন্ন্যাসী। বাবাজী তাই বলেছেন, অন্তরের সন্ন্যাসই আসল সন্ন্যাস। 
অর্চনা পুরী বলেছেন – যার অন্তরে বাসনার সম্যক নাশ হয়েছে, সেইই সার্থক সন্ন্যাসী।
 কাজেই সন্ন্যাসী হতে হলে, যে গৃহত্যাগ করতেই হবে, এরকম কোন কথা নেই। মনে সাধুত্ব থাকলেই, তিনি যথার্থ মানুষ। মনকে করতে হবে ভগবানের মন্দির। আর, মনে রাখতে হবে, তিনি সেই মন্দিরে বসে দিবারাত্র আমাদের উপর নজর রাখছেন, কেউ জানুক, বা না জানুক, তিনি জানতে পারছেন আমি কী করছি। 
জয়দোয়াল গোয়েন্দকার লিখেছেন - কোন লোক যদি টাকা-পয়সার স্বার্থ ত্যাগ করে দেয়, কিন্তু শরীরের আরাম ত্যাগ না করে, সে কামুক। শরীরের আরাম ত্যাগ করলো, কিন্তু মান-সম্মান ত্যাগ করল না, তাহলেও সে কামুক। যে দেহের আরাম, মান-সম্মান, অর্থ সব কিছুর স্বার্থ ত্যাগ করে কর্ম করল, তাকেই নিষ্কাম কর্ম বলে। 
অর্থলোভী অর্থকে যতটা কদর করে, তার চেয়েও বেশি কদর করতে হবে ভগবানকে। এই প্রসঙ্গে তিনি আরেক জায়গায় লিখছেন – ফুলের মালায় সম্মান দেখানো হয়, আর জুতোর মালায় অপমান বোঝানো হয়। যিনি এই ফুলের মালার মধ্যে জুতোর মালা দেখেন, আর জুতোর মালার মধ্যে ফুলের মালা দেখেন, তিনি মান-সম্মানকে ত্যাগ করেছেন বলে ধরা যেতে পারে।
অসমের হাইলাকান্দি থেকে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে বাবাজী মহারাজ লিখছেন, শ্রীজানকীদাসজীর একটি কথা – সাধু হয়ে উপযুক্ত লক্ষ্য যদি না থাকে, তবে আশ্রমবাস করলেই এক ফল লাভ হবে না। সাধুবেশ এবং আশ্রমের সুযোগ নিয়ে যদি লোকচক্ষুর অন্তরালে চুরি, চরিত্রহীনতা ইত্যাদি করতে থাকি, তাহলে, আশ্রমে বাস করেও আমি ব্রম্ভ বিদ্যার অধিকারী হব না। 
আমি এই কথাগুলো লিখলাম কেন জানেন? লিখলাম শ্রী বাবাজীর এই ধরাধামে আসার মূল উদ্দেশ্য কী ছিল, তার একটা ইঙ্গিত দেওয়ার জন্য। শ্রী জানকীদাসজী বাবাজীকে সেই শিক্ষাই দিয়ে গিয়েছিলেন। তাই বহু ‘অন্যায়’ এর প্রতিবাদ বাবাজী সোচ্চারে করেছেন। কাউকে আঘাত দিয়ে নয়, অন্যকে দায়ী করে নয়। 
লক্ষ্য করবেন, শ্রীজানকীদাসজী এই কথাগুলোও বলেছিলেন First person narrative এ। তিনি চেয়েছিলেন, ধর্মের নামে যে অনাচার হয়, সেগুলো সবাই জানুক, শিক্ষা নিক। 
কিন্তু, যখন দেখলেন, আমরা, একশ্রেণির ‘সাধু’রা, একশ্রেণির আশ্রমবাসীরা সেই শিক্ষা নেওয়া দূরে থাক, এমন কিছু আচরণ করছেন, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়, দাদাজী মহারাজও চুপ করে গিয়েছিলেন। আমাদের বাবাজী মহারাজ শ্মশান বৈরাগ্য পছন্দ করতেন না। ভালোবাসতেন সঙ্গীত, কবিতা, সাহিত্য, নাট্যচর্চা, প্রবচন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাটক অভিনয় করাতেন। কিন্তু, একশ্রেণির মানুষের ‘অভিনয়’ দেখে দেখে তিনি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। 
সরাসরি কোনদিন কিছু বলেন নি, কিন্তু নানাভাবে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। কিন্তু, কে শোনে কার কথা।
শ্রীবাবাজী মহারাজের শিষ্যা মুনমুন মুখার্জীর ছেলের উপনয়নে বাবাজী মহারাজ

যাইহোক আজকের লেখায় আসি। 
১৯৮৯ সাল। অসুস্থ শ্রীজানকীদাসজীকে বিমানে নিয়ে আসা হল ভেল্লোরে। তার সুচিকিৎসার প্রয়োজন। কেননা কুম্ভমেলার পর থেকেই তার শরীর ভালো যাচ্ছিল না। ভেল্লোরের ডাক্তারবাবু জানালেন, তার শরীরে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন। 
বাবাজী মহারাজ লিখছেন –“অস্ত্রোপচারের আগের দিন রাতে বাবার মাথার মধ্যে ওজন বেধে ট্র্যাক্সন দেওয়া হল। এই দৃশ্য দেখলে চোখে জল আসে। কিন্তু, শ্রীবাবাজী মহারাজ নির্বিকার শুয়ে আছেন। অপারেশন টেবিলে তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় জিজ্ঞাসা করা হয় – ‘আপনার কি কষ্ট হচ্ছে?’ 
 বাবা বললেন, ‘না, আমার কোন কষ্ট নাই। আমি আত্মস্থ হয়ে আছি।‘
 ছয় ঘন্টা ধরে অস্ত্রোপচার হয়। আর এই অস্ত্রোপচারের দিন দুই-তিন পর তাকে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয়। তিনি তখন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে আছেন, রক্তচাপ ঠিক থাকছে না। ওঠানামা করছে। ডাক্তারও চিন্তায়। 
সেই সময় শ্রীবাবাজী বলছেন- ‘এখানকার বালিশগুলো খুব সুন্দর। দেখিস তো বাজারে পাওয়া যায় কি না।‘ 
শ্রীজানকীদাসজীকে এই রক্ত দেন এক গৃহী শিষ্য। কলকাতার বাসিন্দা। নাম শ্রীবিধুভূষণ সরকার।
দেখুন পাঠকরা। শ্রীদাদাজী মহারাজের শরীরে রক্ত দিলেন তারই এক গৃহী শিষ্য। তার ভাগ্য কতটা ভালো হলে এরকম হয়।
 আসলে, মানুষকে ভালো হতে হয়। সেজন্যই আমাদের বাবাজী মহারাজ মানুষ গড়তেই এসেছিলেন। তিনি ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর। তার উদ্দেশ্যই এটা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েও তিনি মানুষ গড়তে পারতেন। 
কিন্তু, বেছে নিয়েছিলেন টাকা-পয়সা হীন এই সন্ন্যাসী জীবনকে। যাতে কোন কিছুর বিনিময়ে তাকে মানুষ গড়তে না হয়। মাইনের বিনিময়ে, তিনি মানুষ গড়তে চাননি। তাই তথাকথিত শিক্ষক হননি। হয়েছিলেন এক আধ্যাত্মিক শিক্ষক, বিজ্ঞানী। যাইহোক, শ্রীজানকীদাসজীর জন্য রক্ত দিলেন বিধুভূষণ সরকার। গ্রুপ মিলিয়ে রক্ত দেওয়া হল। 
বাবাজী মহারাজ লিখছেন – “বাবাকে রক্ত দিতে গিয়ে কোন কারণে reaction হয়ে যায়। তার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়লে তাকে নিয়ে আসা হয় ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। এরপর তার আর একটি ছোট অপারেশন হয়। তিনি সুস্থ হলে নিয়ে আসা হল কলকাতায়।“

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad