ক্ষুদ্র ‘আমি’ র মধ্যেই লুকিয়ে আছে বৃহৎ ‘আমি’ তথা পরমাত্মা, তার সঙ্গে যোগসূত্র উপলব্ধি করাটাই ভগবান লাভ

 




এই লেখা আমার ক্ষুদ্র ‘আমি’র প্রয়াস। আমার ‘আমি’র উপলব্ধি। ভেবে দেখতে পারেন। এটাই ‘আমি’ বলতে পারি।

যদি আমরা ভগবানের কাছে মোক্ষলাভের কামনাও করি, সেটাও চাওয়া। ভগবানের দেখা চাওয়াটাও চাওয়া। অন্যের ভালো চাওয়াটাও চাওয়া। এই ‘চাওয়া’ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারলে তবেই আমরা এগোতে পারবো ভগবানের পথে/ আর সেই ভগবান কোথায় থাকেন? মন্দিরে? আশ্রমে?

 

তারক ঘোষ


প্রথমেই বলি খুব কঠিন। অথচ খুবই সহজ। অদ্ভুত লাগতে পারে, এই বিপরীত কথাগুলির পাশাপাশি থাকাটা। কিন্তু, এটাই সত্য। আমাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছেন তিনি, অথচ আমরা তাকে খোঁজার জন্য কোথায় না ছুটে যাই! মন্দিরে, মসজিদে, গীর্জায়, গহন জঙ্গলে কিংবা হিমালয়ের কোনো গোপন গুহায়। সংসার ফেলে, সামাজিক দায়িত্ব ফেলে জীবন থেকে পালিয়ে গিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যাই। কিন্তু খোঁজ মেলে না তার। ধ্যানের গভীরে লুপ্ত হয়ে অন্বেষণ করে যাই  জীবনের সেই সারবস্তুকে। কিন্তু, পাই না।

মনে প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি আছেন তিনি? না কি সবটাই আমাদের কল্পনা? বহু সাধু-সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞেস করেছি, কীসের জন্য ঘুরে বেড়ান হিমালয়ে, সাগরে, কুম্ভে? কেউ বলেছেন ভগবানের সন্ধানে, কেউ বলেছেন, নিজেকে খুঁজতে, কেউ বলেছেন,  এটাই ধর্ম। কিন্তু, আমার মন মানে নি। সত্যিই কি এই সাধু-সন্ন্যাসীরা ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছেন? সত্যিই কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব পরশপাথর ঈশ্বর তথা ভগবানকে, যার স্পর্শে আমাদের এই ক্ষুদ্র জীবন খুঁজে পাবে পরমাত্মার সঙ্গে তার ‘মিসিং লিঙ্ক’।



হ্যা, সম্ভব। শুধু ভুল পথে আমরা ছুটে চলেছি বলেই আজও হয়নি ভগবান দর্শন। আসলে ভগবান দর্শন নয়, নিজের মধ্যে পরমাত্মার পায়ের ছাপ দর্শন, সেই আনন্দস্বরূপ ঈশ্বরের দর্শন। আর সেই অনুভূতি যদি সত্যিই সম্ভব হয়, তাহলেই আমরা বুঝে যাব, আমরা কেন এসেছি, আমাদের কর্তব্য কী?

আমরা আমাদের এই ক্ষুদ্র ‘আমি’কে কখনই ভুলতে পারি না। আমরা ভাবি এই ক্ষুদ্র ‘আমি’ আমার অহং। আর এটাই আমাদের প্রথম ভুল। ভুল এ জন্যই, এই ‘আমি’ তথা জীবাত্মার মধ্য দিয়েই পরমাত্মাকে পাওয়া যায়, তার অস্তিত্ব বোঝা যায়, তার স্বরূপ চেনা যায়। তার সঙ্গে যোগসূত্র পাওয়া যায়। কিন্তু, আমরা আমাদের মধ্যে থাকা ‘আমি’দের ব্যবহার করি নিজ  নিজ সুখ খোঁজার জন্য। আত্মদর্শন নয়, আত্মসুখ। আর এই আত্মসুখ খুঁজতে গিয়ে সামনে খাড়া করি ভগবানকে। সত্যিই কি আমরা ভগবানকেই সারবস্তু ভাবি? একটু ভেবে দেখা যাক। ধরুন, আমরা ঠাকুরের কাছে কী কামনা করি? ঠাকুর আমাদের ভাল রেখো, সব কষ্ট দূর করে দাও। লক্ষ্য কী? সুখ। লক্ষ্য কারা? সেই আমি বা আমরা। ঠাকুরের কাছে সেই নিজের সুখ চাওয়া, নিজের ভালো চাওয়া। কেউ বা, আর এক ধাপ এগিয়ে বলেন, ঠাকুর সবাই যেন ভাল থাকে। অর্থাৎ, আমরা নিজেরা এই কথাগুলোর মধ্য দিয়ে নিজেদের বোঝাই, আমি কতটা এগিয়ে, নিজের ভালো না চেয়ে, সকলের ভাল চাইছি।

এতে কোনো লাভ হয় না, এইভাবে অধ্যাত্মবাদের পথে এগোনো যায় না। কারণটা কী?

কারণ আর কিছু নয় – আমরা সেই চাইছি। ভগবানের কাছে চাইছি। নিজেকে কেন্দ্র করেই সব কিছু। ভগবানকে কেন্দ্র করে নয়। কেউ বলছেন, ভগবান যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। অথচ, কষ্টে পড়ে ভগবানকে ডাকেন – প্রভু, আমাকে এই কষ্ট থেকে উদ্ধার করো।

কেন? ভগবান যা কিছু করেন, সবই যদি ভালোর জন্য করেন – এই বিশ্বাস আমাদের হয়ে গেছে, তাহলে, কেন ভাবতে পারছি না, এই মুহুর্তে আমাকে দেওয়া কষ্টটাও তারই দেওয়া, আর সেটা আমার ভালোর জন্যই। এই হচ্ছি আমরা, একটা মোহ, একটা ব্যক্তি সুখের আশায় ছুটে চলেছি, স্বার্থ নিয়েই ঈশ্বরকে ডাকছি, কেউ জটা দাড়ি রেখে সাধু হচ্ছি, তারপর আবার সেই একই খেলা, সাধু হয়েও ছুটে চলেছি টাকার সন্ধানে। মানুষকে বোঝাচ্ছি, ভগবান লাভই হলো, আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য। কিন্তু, কীভাবে? কেই এই ভগবান, কীভাবে পাওয়া যাবে তাকে? সব প্রশ্নের কোথাও পরিষ্কার উত্তর নেই। ভাসা ভাসা উত্তর। আবার কেউ উত্তর পেয়ে নিরুত্তর। যারা উত্তর পেয়েছেন, তারা নিজেরাই হয়ে যান ভগবানের অংশ। আর এটাই স্বভাবিক। তারা হয়ে যান সদগুরু, প্রত্যক্ষ ভগবান। তারা চেষ্টা করেন মানুষকে বোঝানোর, রাস্তা দেখানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু, সবাই শোনাউল্লা হয়েই রয়ে যান।

দেখুন, আমরা সকলেই পরমাত্মার অংশ। এক তিনি বহু হয়ে ছড়িয়ে আছেন লক্ষ ‘আমি’র মধ্যে। এই লক্ষ আমি আবার মিশে যাচ্ছে সেই পরমাত্মার মধ্যে। লীন হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর পর তাই হচ্ছে। জীবাত্মা মিশে যাচ্ছে পরমাত্মার সঙ্গে। যেমন, নদী মিশে যায় সাগরে। আমাদের পরমাত্মার সঙ্গে মিলন- সেটা আমরা কাউকে জানাতে পারছি না। তাই অনেকেই চান দেহে অবস্থান করেই সেই পরমাত্মার সঙ্গে মিলন করতে। তাকে জানতে, তার সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করতে।আর জীবিত অবস্থায় পরমাত্মার সঙ্গে এই যোগসূত্রের অন্বেষণই হলো ভগবানএর অন্বেষণ।

আমাদের জীবনে ‘চাওয়া’ হলো এমন একটা ভাগ অঙ্ক, যার ভাগশেষ নেই, ভাগফলের ঘরে শুধুই দশমিকের পর একটার পর আর একটা সংখ্যা, যার শেষ নেই। আর সুখ হলো আপেক্ষিক। একটু খুলে বলি – আমাদের চাওয়ার শেষ নেই- এটা যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি, সুখ অলীক হলেও আমরা কখনো অন্যের সুখে সুখী হই না, সুখী হওয়ার অভিনয় করি। ভাবুন, ঈশ্বর আপনাকে বিশাল একটা বাড়ি করে দিলেন। কিংবা মনে করুন, আপনিই সেই বাড়িটা করলেন। সেই সুবিশাল প্রাসাদোপম বাড়িতে বসে আপনি সেই বিরাট বাড়ির মালিক হয়ে নিশ্চয় সুখ অনুভব করবেন। সবাই যখন আপনার সুন্দর বাড়ি দেখে আপনার রুচির তারিফ করবেন, আপনার অগাধ অর্থের কথা বলবেন, তখন নিশ্চয় খুশী হবেন, মনের কোনে সুখের বুদবুদ উঠে আসবে। মুখে বলুন, বা না বলুন, এটা হবে।




এটাই সুখ। কিন্তু, এই সুখের স্থায়িত্ব কতক্ষণ? যতক্ষণ, আপনার সেই বাড়ির পাশে গরীব মানুষের বাড়ি থাকবে, আপনার বাড়ির পাশে আরো সুবিশাল বাড়ি তৈরি হলে, আপনার মনে আর আগের সুখ থাকবে না। একটা কোমল দুঃখ কিংবা চোখ টাটানো দেখা দেবে আপনার মন জুড়ে। আবার একটা চাওয়া জন্মাবে। এই চাওয়াটাই ছাড়তে হয় আমাদের। কিন্তু, সেটা কি আমরা ছাড়ি? বাড়ি-গাড়ি-পার্থিব সুখের কথা ছেড়ে দিন। এসব না চেয়েও যদি আমরা ভগবানের কাছে মোক্ষলাভের কামনাও করি, সেটাও চাওয়া। ভগববানের দেখা চাওয়াটাও চাওয়া। অন্যের ভালো চাওয়াটাও চাওয়া। এই ‘চাওয়া’ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারলে তবেই আমরা এগোতে পারবো ভগবানের পথে/ আর সেই ভগবান কোথায় থাকেন? মন্দিরে? আশ্রমে?

নাঃ থাকেন আমাদের মধ্যে, ক্ষুদ্র ‘আমি’ রূপে। যে ‘আমি’ নিমেষে হতে পারে পরমাত্মার ক্ষুদ্র অংশ। আর এই ভাবনাটাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন। তবেই আমরা দর্শন পেতে পারি ঈশ্বর তথা পরমাত্মার। কিন্তু, সেই পেতে গেলে ভুলতে হবে সব। সব চাওয়া, সব অপেক্ষা।

চলবে…

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad