কিন্তু এটাই সত্য – যার জীবনে পরীক্ষা নেই, তার উত্তরণও নেই।
তারক ঘোষ
বুঝলাম, প্রকৃত ভক্ত সবকিছুর মধ্যেই ঈশ্বর
তথা তার ইষ্টদেবতা ও শ্রীগুরুর অস্তিত্ব অনুভব করেন। হারিয়ে ফেলেন তার নিজ অস্তিত্ব,
সমস্ত দ্বিধাবোধ, তার জাত-পাতের উপলব্ধি। তার সামনে শুধু থাকে ভক্তি আর বিশ্বাসের এক
মিশ্রিত চেতনা। সেই চেতনায় তারা প্রণাম করতে পারেন, তাদের গুরুভাইকেও। সেই ভক্তের মধ্য
দিয়ে ঈশ্বরের আর এক রূপ উপলব্ধি করা যায়। বাবাজী মহারাজের কথায় Unity in
Diversity. এক তিনি বহু রূপে বিরাজমান –গুরুরূপে, ভক্তরূপে। আর স্বয়ং ভগবান তো প্রকৃত
ভক্তের ‘দাস’ হয়ে যান। তাইতো তিনি ভক্তের ভগবান।
গতকাল আমার সেই উপলব্ধি হলো বাবাজী মহারাজের
এক ভক্ত শিষ্যকে দেখে। ভদ্রলোক বিগত ১৯৯৪ সাল থেকে বাবাজী মহারাজের সাহচর্য্য পেয়েছেন।
তার স্ত্রী রামকৃষ্ণ মঠের শিষ্যা হলেও বাবাজী মহারাজকেও গুরুজ্ঞানে ভক্তি করে আসছেন
সূদীর্ঘ সময় ধরে। বাবাজী মহারাজ তার বাড়িতে তার পদধূলি দিয়েছেন, ধন্য করেছেন তার সেই
শিষ্য-ভক্তকে।
তার সেই গৃহের নামও বাবাজী মহারাজের নামে।
শ্রীপ্রজ্ঞাভবন। এক অবারিত শান্তি সেই বাড়িতে। তার দোতলার ঘরে বাবাজী মহারাজ উঠতেন।
হাজারো মানুষ ভিড় করতেন। প্রবচন হতো। আর আশ্চর্য্যের কথা, সেই স্মৃতি ধূলায় ঢাকা পড়ে
যায় নি। এখনো উজ্জ্বল করে রেখেছেন গৃহকর্তা, গৃহকর্ত্রী, নাবালক পুত্র আর নাবালিকা
কন্যা। সেই বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করেই এক অপরূপ পজিটিভ শক্তি টের পেলাম। আনন্দ আর আলোয়
যেন সেই গৃহ আজও বাবাকে ধরে রেখেছে। চমকে উঠলাম যখন বিদায়কালে বয়স্ক গৃহকর্তা আর তার
স্ত্রী-সন্তানরা ‘আমি’ নামক এক অধমের মধ্যে দিয়ে শ্রীভগবানকে প্রণাম জানালেন। ধন্য
হয়ে গেল, ‘আমি’ নামক এই আধার। আমার পায়ে তাদের হাতের স্পর্শে আমি যেন পাপ মুক্ত হলাম,
আমার ‘আমিত্বের’ অহঙ্কার চলে যাওয়ার আগে বলে উঠল – এদের দেখে শেখ। এরা জন্মসূত্রে কিন্তু
ব্রাহ্মণ। ভক্তের আসল স্বরূপ দেখে নে। এরা যতটা না বাবাজী মহারাজের ‘শিষ্য’, তার চেয়েও
তার বড়ো ‘ভক্ত’, তাই গুরুভ্রাতার পায়ে হাত দিয়ে প্রণতি জানাতেও দ্বিধা করেন নি।
ধন্য হল ‘আমার আমি’। জ্ঞানচক্ষু খুলে গেল।
আমরা কতো অহঙ্কারী! কিন্তু, সেই অহঙ্কারকে একশ্রেণির শিষ্য হেলায় উড়িয়ে দিয়ে কতো সহজে
ভক্ত হওয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছেন। আমাদের বাবাজী মহারাজের মধ্যে গুরুভাব এর
চেয়ে বেশি ছিল শিষ্যভাব। তিনি সারাটা জীবন শিষ্য ভাবেই সবকিছু করেছেন। তাই অনায়াসে
সব কাজেই সফল হয়েছেন। তার শ্রীগুরুদেবকে সারথীর আসনে রেখে ‘যুদ্ধ’ করে গেছেন কুসংষ্কার
আর অন্যায় এর বিরুদ্ধে। সমাজকে কলূষমুক্ত করার প্রয়াস চালিয়েছেন। গুরুশক্তি তার অন্তরে
ছিল সদা বিরাজমান। সেই গুরুশক্তিকে পাথেয় করে তিনি এগিয়ে গেছেন জীবন আর ঈশ্বরবোধে তার
শিষ্যদের চেতনা ফেরাতে। ব্যর্থ আমরা। ভক্ত হওয়া তো দূরের কথা, শিষ্য হওয়ার যোগ্যতার
পরীক্ষাতে ঠি্কঠাক নম্বর পাই নি। ধন্য বাবাজী মহারাজের সেই সমস্ত গুপ্ত-যোগী ভক্তরা।
দেবতার স্পর্শ পেয়ে তারা ধন্য। শুধু পরশ নয়, আজও তারা প্রতিদিন বাবার কথা ভেবে চোখের
জল ফেলেন। বাবার কথা বলতে বলতে তারা নির্বাক হয়ে যান।
বাবার এই ভক্তরা কখনো প্রকাশ্যে সেইভাবে আসেন
নি। তারা আছেন। আমি তাদের দেখেছি, বর্ধমানে, নদীয়ায়, আসামে, বিহারে, ভারতের রাজধানীতে।
তাদের জীবন-ধারা বাবার দেখানো পথেই বয়ে চলেছে। তাদের মধ্যে ভক্তির উচ্ছ্বাস নেই, ভক্তির
কান্না আছে।
পরমহংস যোগানন্দের জীবনী থেকে একটা অংশ লিখছি
– “শিশুর ন্যায় সরল বিশ্বাসে তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, তুমিও কি আমায় ঐ রকমই ভালবাসা
দিতে পারবে?
বললাম – গুরুদেব, চিরকালই আমি আপনাকে ভক্তি
করব।
নম্রমধুর স্বরে তিনি বললেন – সাধারণ ভালবাসা
স্বার্থময়, কামনা-বাসনা পরতৃপ্তির গাঢ় অন্ধকারেও এর মূল দৃঢ় হয়ে থাকে। স্বর্গীয় ভালবাসা
প্রতিদান চায় না।, তা সীমাহীন, তার কোনো পরিবর্তন নেই। অনাবিল প্রেমের ছোঁয়ায় মানব মনের
আবিলতা চিরতরে দূর হয়ে যায়।“
গীতার ব্যাখ্যায় বাবাজী মহারাজ বলছেন – “ভক্তের
কথা বলতে গিয়ে ভগবান বলছেন – তিনি সর্বভূতে দ্বেষরহিত, মিত্রভাবাপন্ন, করুণাময়, মমত্ববুদ্ধিশূন্য,
নিরহঙ্কার, সুখ ও দুঃখে সমভাবাপন্ন ও ক্ষমাশীল হন। তিনি শত্রু-মিত্র, মান-অপমান, শীত-গ্রীষ্ম,
দুঃখ-সুখকে সমজ্ঞান করেন। তিনিই ভগবানের প্রিয় ভক্ত।
আর একটি শ্লোকের ব্যাখ্যায় বাবা লিখছেন –
এক আত্মাকে যিনি সর্বভূতের মধ্যে দর্শন করেন, নিজের আত্মাতেও দর্শন করেন, তার সুখ শাশ্বত
হয়।
যা দিয়ে শুরু করেছিলেম, আমরা অনেকেই এখনো
ভক্ত হতে পারিনি, বাবা আমাদের এখনো পরীক্ষা নিয়ে চলেছেন অবিরত – নানা অবস্থার মাঝে
ফেলে। নিচ্ছেন, আমাদের ভালো চান বলেই। মাঝে মাঝে বুঝতে চাই না, কিন্তু এটাই সত্য –
যার জীবনে পরীক্ষা নেই, তার উত্তরণও নেই।