‘জয়গুরু’, ‘রাধে রাধে’ কি এখন ‘গুড মর্নিং’ ‘গুড ইভনিং’ কিংবা ‘গুড বাই’, ‘বাই বাই’ এর বিকল্প হয়ে উঠছে?

 




আশ্রমে তখন ভক্তদের ঢল নামত, গুরুদেবের কথা শোনার জন্য সকলের ভক্তি গদগদ প্রাণ। গুরুদেবের পার্থিব শরীর ত্যাগের প্রায় ১০ বছর পরে চিত্রটা একেবারেই বদলে গেছে। হারিয়ে গেছে ভক্তির সেই প্লাবন

তারক ঘোষ


নিজেকে বড় ভক্ত প্রমানের জন্য বা নিছকই সম্ভাষণ বিনিময় বা বিদায় সম্ভাষণ জানানোর জন্য আমরা যারা কৃষ্ণভক্ত বলে দাবি করি, বেছে নিয়েছি ‘জয়গুরু’, ‘রাধে রাধে’ শব্দগুলিকে। ফলে, ওই শব্দগুলি তাদের ভার হারিয়ে ভীষণ লঘু হয়ে পড়ছে আমাদের একশ্রেণির ভক্তদের অতিভক্তির দাপটে। শ্রীশ্রীজানকীদাসজী মহারাজ ও বাবাজী মহারাজ একেবারেই পছন্দ করতেন না কথায় কথায় ‘রাধে রাধে’ বলাটা। বাবাজী লিখেছেন – এ জন্য অনেকে শ্রীগুরুজীকে দাম্ভিক মনে করতেন, কিন্তু তিনি সেকথায় কিছু মনে করতেন না, বলতেন শ্রীরাধারাণী আমাদের উপাস্য দেবী, তাকে এইভাবে সর্বত্র প্রকাশ্য স্থানে নামিয়ে আনা ঠিক নয়।

এখানেও দেখি বহু মানুষ তাদের ভক্তির প্রকাশ করতে গিয়ে পোস্টের নীচে ‘রাধে রাধে’ লেখেন। জানিনা, তারা বাবাজী মহারাজের এই কথাগুলো পড়েছেন কিনা, কিংবা তারা শ্রীশ্রী জানকীদাসজীর এই দিকটার কথা শুনেছেন কিনা।  আসলে, আমরা গুরুদেবের আদর্শ বা বাণী বা তার দেখানো পথে যতটা না যেতে পারি, ভাবটা দেখাই অনেক বেশি।  কারণ, শ্রীগুরুর নির্দেশ মানা খুবই  কঠিন, তাই ওপথে যাওয়ার চেয়ে সস্তায় ভক্তি প্রকাশ করি। ‘জয়গুরু’, ‘রাধে রাধে’ শুনে লোকেও বুঝে যায়, আমরা কীরকম ভক্ত! আসলে ভণ্ডামী আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে, কেউ জটা-দাড়ি রেখে বৈরাগী হয়ে পড়ছে, মনে কামনার পাহাড়, কেউ বা ভক্তি দেখানোর জন্য বিশাল উৎসব করে নরনারায়ণ সেবা করছেন। সেবা নিঃসন্দেহে ভালো লক্ষণ, যদি সেই সেবার মধ্যে অহঙ্কার, মান-যশের আকাঙ্ক্ষা না থাকে। আর বিষয়টা শুধু প্রচার কেন্দ্রিক হলে, সেটা আর নিঃষ্কাম সেবা থাকে না।



আসলে ভক্তি যে কী জিনিষ সেটা আমরা কম বুঝি। যেটা বুঝি সেটা হল শ্মশান বৈরাগ্য আর স্বার্থ। স্বার্থ ফুরালে আমরা আর কাউকেই চিনি না। তিনি যেই হোন না কেন। আশ্রমে তখন ভক্তদের ঢল নামত, গুরুদেবের কথা শোনার জন্য সকলের ভক্তি গদগদ প্রাণ। গুরুদেবের পার্থিব শরীর ত্যাগের ১০ বছর পরে চিত্রটা একেবারেই বদলে গেছে। হারিয়ে গেছে ভক্তির সেই প্লাবন। এখন সন্দেহ হয়, আমরা তাহলে সবটাই ব্যক্তি-স্বার্থসিদ্ধির  জন্যই করতাম? এর মাঝে অবশ্যই বহু ভক্ত আছেন, যারা আজও গুরুদেবের পথ অনুসরণ করে চলার চেষ্টা করেন। এদের সংখ্যা নগন্য। এরা ভক্ত হয়েই জন্মান, আচমকাই ভক্ত হয়ে যান না, বা কাজ ফুরালে কেটে পড়েন না। বাবাজী মহারাজ তাই একবার বলেছিলেন, আসল ভক্তের সংখ্যা ৫ কি ৬, তার বেশি নয়।

ইদানিং বাবাজী মহারাজের এই কথাগুলোই বার বার মনে পড়ে। কতটা কষ্ট পেলে, তিনি ‘করিমউল্লা নেই’ – কথাগুলো বলতে পারেন।

ভক্ত ও ভক্তি প্রসঙ্গে বাবাজী মহারাজ বলছেন – একটা মুহুর্ত ঈশ্বরকে ভুলে থাকার জন্য যে মনোকষ্ট সেটা হলো ভক্তি। ভক্তরা যে জায়গায় থাকেন, সেটা তীর্থ হয়ে ওঠে। ভক্তদের সদ্গ্রন্থ পাঠ তীর্থকেও তীর্থ করে। যে বংশে একজন ভক্ত জন্মায়, সেই বংশের পূর্বপুরুষরা আনন্দে নৃত্য করে। সব প্রশ্নের পাড়ে যাওয়ার পর তবেই অন্তরে ভক্তি আসে।



বাবাজী মহারাজ সুখ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বললেন – আপনারা যেগুলো সুখ মনে করেন, যেমন অর্থ-সুখ, পত্নি-সুখ – এগুলো প্রকৃত সুখ নয়, দুঃখের নামান্তর। ভগবান বলছেন, এই সুখ ক্ষণস্থায়ী। আসলে, এই জগতে কোনো জিনিষটাই স্থায়ী নয়।

বিজ্ঞানও এটাকেই মানে। সব কিছুই আপেক্ষিক। একমাত্র নিত্য হল ভগবান, যাকে লাভ করলে পাওয়া যায় শান্তি আর স্থায়ী সুখের ঠিকানা। কিন্তু, এই পথ সকলের জন্য নয়। আত্মবিশ্লেষণ, আত্মগ্লানি ও আত্মদর্শন এর মধ্য দিয়েই এই পথে আসা যায়। লোভী, অহঙ্কারী ও কামুক মানুষদের জন্য পার্থিব সুখটাকেই ভগবান বেছে রেখেছেন। তারা এই পথেই গমন করবেন, তারপর একদিন পৃথিবীর নিয়মে মৃত্যুর পথে রওনা দেবেন। ভক্তির পথ তাদের জন্য নয়। টাকার গরমে তারা যতই বাহ্যিক ভক্তি দেখান না কেন, সেসব নিঃস্ফল। একেবারে মৃত্যুর প্রাকমুহুর্তে তারা একথা বুঝতে পারবেন, তখন আর ফেরার রাস্তা বন্ধ। নিঃষ্কাম কর্ম, ভগবানে বিশ্বাস রেখে সৎ কর্ম করে যাওয়া আর সংসারী মানুষদের সব দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে যাওয়াটাই ভক্তি।



বাবাজী মহারাজের কথায় – মুখে হরিবোল, ভিতরে গাঁটরী খোল।

এখন সমাজে এইসব মানুষদের সংখ্যাই বেশি, যারা পাপ করে টাকা ছুঁড়ে দিতে চায়। পুজোয় ‘নগদ’ ধরে দেওয়ার মতো, বা কেস ধামা-চাপা দেবার মতো, বা টাকা দিয়ে অপরাধ চেপে দেওয়ার জন্য। এরা ভগবানকেও ঘুষ দিতে যায়। ঈশ্বরকেও অর্থের অহঙ্কার দেখাতে চায়।

বাবাজী মহারাজ তো বলেই ফেলেছিলেন, অনেক ‘সাধু’ আবার ভক্তদের পুজো পেতে পেতে নিজেদেরই ঈশ্বর ভেবে ফেলেছেন। এইশ্রেণীর গৃহী ভক্তরা নিজেদের এত বেশি ভক্ত ভাবেন যে আশ্রমে অর্থ দান করে, বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিতে যান। কোনো কোনো আশ্রমে সাধারণ গরীব ভক্তদের চেয়ে এই শ্রেণির ভক্তদের কদর বেশি। কিন্তু, ঈশ্বরের বিচারে ভক্তদের কোন জাত হয় না, ধনী বা দরিদ্র ভেদ থাকে না। ভক্তিই একমাত্র মাপকাঠি।

কিন্তু, যুগ বদলেছে, তাই জয়গুরু বা রাধে রাধে হয়ে উঠছে ‘গুড ইভনিং’ কিংবা ‘গুড বাই’, ‘বাই বাই’ এর বিকল্প। এই কদিন আগেই এক ভক্ত আমাকে দেখে বলে উঠলেন – ‘রাধে রাধে, কেমন আছেন?

বললাম, ভালোই।

তিনি বললেন, জয়গুরু। তাহলে চলি? আবার কবে দেখা হবে রাধে রাধে?

বললাম, যেদিন আবার পথে আসবেন।

উনি বললেন – তাহলে রাধে রাধে।

এটাই এখন চলছে, বাবাজীর পোস্টের নীচে প্রতিদিন এরকম দেখি আর বাবাজীর কথাগুলো মনে হয়। এরা ইষ্টদেবী শ্রীরাধারাণীকে একেবারে প্রকাশ্য স্থানে নামিয়ে এনেছে।



Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad