বাবাজী মহারাজের গবেষণা নিয়ে কী বলেছিলেন তার গুরুদেব স্বামী জানকীদাসজী মহারাজ?

আজ মহা-শিবরাত্রী। এই দিনে বাবাজী মহারাজ সারাদিন উপবাসে থাকার পর সন্ধ্যায় সকলকে নিয়ে আমগাছের নীচে বসতেন। আজ সেই দিন। বাবাজী আজও আমাদের মধ্যেই। মহা-শিবরাত্রীর এই দিনে উজ্জ্বল তার জ্ঞানী দুই চোখ। ভারতের এক মহা-সাধক। তার শ্রীচরণে প্রণাম জানাই।
তারক ঘোষ


 বাবাজী মহারাজ অর্থাৎ সমাজতত্বের একজন কৃতি-জ্ঞানী ছাত্র তথা আর এক জ্ঞানতপস্বী সাধক স্বামী জানকীদাসজী মহারাজের শিষ্য প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া যখন সমাজতত্বের এই দূরূহ বিষয় নিয়ে গবেষণায় হাত দেন তখন পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী শাসন চলছে।
 ঠিক এইরকম এক পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণাপত্র রচনায় মন দিলেন সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া। তিনি ডঃ অমরনাথ ভট্টাচার্যের তত্বাবধানে মন দিলেন গবেষণায়। একদিকে, মার্কসবাদ ও অন্যদিকে নিম্বার্কবাদ- দুটি ভিন্নমুখী ও ভিন্ন-চিন্তাধারাকে তিনি নিয়ে এলেন এক মঞ্চে। এটা এক ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ ছিল ওই ছাত্র জীবনে। 
কেননা, তিনি ছাত্র-জীবন থেকেই ভেবে নিয়েছিলেন, তার পথ হবে সমাজের মঙ্গল সাধণের পথ। অন্তরে সন্ন্যাসী এই ছাত্রের তপস্যা ছিল মানুষের জন্য তথা এই মানব-সমাজের জন্য এমন কিছু করা, যা সার্বিক মঙ্গল করবে সমগ্র সমাজ-ব্যবস্থার। বদলে যাবে, ভারতীয় সমাজের প্রচলিত ফর্মূলা। আর এইখানেই তার সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য। 
আর এই কারণেই ভবিষ্যতের ভারত যুগ যুগ ধরে মনে রাখবে এই জ্ঞান-তপস্বী বিজ্ঞান-মনস্ক গবেষক সন্ন্যাসীকে, যার সঙ্গে আর কারো তুলনা হয় না- না জ্ঞানে, না মানুষের মঙ্গল বিধানের জন্য এক নতুন তত্বের আবিষ্কারক হিসাবে। 
১৯৯১ সালে, সমাজবিজ্ঞানের এই ছাত্র লাভ করলেন ডক্টরেট। তার এমএ ডিগ্রির সঙ্গে যুক্ত হল- পিএইচডি –ড.প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া। এখন দেখা যাক, তার এই সুযোগ্য ছাত্র সম্পর্কে তার জ্ঞানী গুরুদেব স্বামী জানকীদাসজী কী ধারণা পোষণ করতেন।
জানকীদাসজী বলছেন –“ছাত্রজীবন থেকেই কার্ল মার্কস ও তাঁর নীতির প্রতি আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। এই সময়-কালে বিশ্বের কিছু দেশ মার্কসবাদী সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে কিছু এখনও টিকে আছে। পশ্চিমবঙ্গেও মার্কসবাদী সরকার দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যের জনগণের সমর্থন নিয়ে টিকে আছে।“ (ওনার জীবিতকালে ১৯৯১ সালে এই কথা লেখা হয়েছিল)। 
তিনি লিখছেন- “অনেকে বিশ্বাস করেন যে মার্কসবাদী অর্থনৈতিক নীতিগুলি পৃথিবীতে স্বর্গ নিয়ে আসতে পারে এবং সমাজের সমস্ত মানুষের সম্পূর্ণ সন্তুষ্টির গ্যারান্টি দিতে পারে। আমি মনে করি, মার্কসবাদের ভিত্তি প্রস্তর হল দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। যা জগতকে কঠিন বাস্তবতা হিসাবে গ্রহণ করে এবং এর বাইরে কিছুই নয়। 


মার্কসবাদ ঈশ্বর, আত্মা বা সার্বজনীন ধর্মের জন্য কোনও বিশেষ জায়গা তৈরি করেছে কিনা তা নিয়ে আমার অনেক সন্দেহ রয়েছে। একজন ভারতীয় হিসাবে আমি সনাতন ধর্মের পথ অনুসরণ করে আমার জীবন যাপন করতে পছন্দ করি। বেদান্ত দর্শন অধ্যয়ন করার সময় আমি শঙ্করের চরম অদ্বৈতবাদের সংস্পর্শে এসেছিলাম যা জগতের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে এবং ব্রম্ভাকেই একমাত্র বাস্তব হিসাবে স্বীকার করে।
 যেহেতু চরম অদ্বৈতবাদের মতবাদ আমাকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারেনি, তাই আমি সত্যের সন্ধানে বেদান্ত দর্শনের অন্যান্য বিষয় অধ্যয়ন করতে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলাম এবং শ্রী স্বামী নিম্বারকাচার্য মহারাজের দ্বৈতদ্বৈত বা দ্বৈতবাদী অ-দ্বৈতবাদের মতবাদের সংস্পর্শে এসেছিলাম।
ভগবান নিম্বার্কের দেওয়া শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলির বিস্ময়কর যুক্তি এবং অনন্য ব্যাখ্যায় আমি খুব সন্তুষ্ট হয়েছি। এই তত্ত্ব অনুসারে ব্রহ্ম যেমন সত্য, তেমনই জগতও সত্য। এই শিক্ষা আমাকে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এবং ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র্যকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে। 
এটা সত্য যে প্রতিটি মানুষ, এমনকি প্রতিটি প্রাণী সুখের সন্ধান করে। এই সুখ অর্জনের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন উপায় বেছে নেয়, যেমন খাওয়া, পান করা এবং সিনেমা টিভি উপভোগ করা এবং এমনকি যৌন আকাঙ্ক্ষা, যার ফলস্বরূপ একজন বেশি পায় এবং একজন কম আনন্দ পায়। কিন্তু পার্থিব সুখ বা আনন্দ মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে না। 
কোন পার্থিব আনন্দই মানুষের চিরস্থায়ী ও পূর্ণ সন্তুষ্টির নিশ্চয়তা দিতে পারে না। চিরস্থায়ী শান্তি কেবলমাত্র ব্রহ্মের উপলব্ধির মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে।
এটি উপনিষদের "নলপে সুখমস্তি ভুমাইব সুখম" এই শ্লোকেই পরিষ্কার। আমার মতে বেদান্ত দর্শন এবং মার্কসবাদের নীতিগুলির সংমিশ্রণ মানুষকে পুরোপুরি এবং স্থায়ীভাবে সন্তুষ্ট করতে পারে। যদিও মার্কস এবং প্রথাগত চিন্তাবিদরা আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাগুলিকে দেখেন এবং মোকাবিলা করেন, তবে দুটি সিস্টেমের একটি মিশ্রণ মানুষকে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পারে। এই অবস্থায় আমি আমার শিষ্য স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, মার্কসীয় ও বেদান্ত দর্শনের ক্ষেত্রে গবেষণা করার জন্য। 
ঐশ্বরিক সত্তার অনুগ্রহে স্বামী প্রজ্ঞাদাস এই গবেষণাপত্রটি তৈরি করেছেন যার ভিত্তিতে তিনি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছেন। আমি মনে করি, এই গবেষণাপত্রটি মানব চিন্তার অন্তত একটি ছোট দিককে আলোকিত করবে এবং মার্কস ও নিম্বার্ক তত্বএর মিলিত রূপ নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে একটি নতুন গবেষণা চালানোর জন্য অনুপ্রাণিত করবে।“

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad