দাদাজী মহারাজের মতো বাবাজী মহারাজ বিশ্বাস করতেন কর্মযোগের মাধ্যমেই সাধন পথে ভালোভাবে অগ্রসর হওয়াই ভালো। আর কর্মযোগের সাধন গৃহস্থ জীবনেই সুলভ।
তারক ঘোষ
বাবাজী মহারাজের প্রয়াণ তিথির মাঝেই ভাগবত সপ্তাহের একটা ভিডিও দেখছিলাম। আর সেটা দেখার পর আর একটা ছবি মনে পড়ল। পূর্ব বর্ধমানের মেমারীতে বাবাজী মহারাজের উপস্থিতিতে ভাগবত সপ্তাহের দৃশ্য। একটা বাবাজীর উপস্থিতে, আর একটা বাবাজীর অনুপস্থিতিতে অর্থাৎ বাবাজী মহারাজের প্রয়াণের পর।
সাম্প্রতিক এই ভিডিওর উচ্ছ্বাস নিয়ে আমার কিছু বলার নেই, বলার ইচ্ছাও নেই।
কিন্তু, এই প্রসঙ্গে শ্রী জানকীদাসজীর ওই কথাটা মনে পড়ল –“আজকাল আশ্রম ইত্যাদি স্থানে ঈশ্বর চিন্তার অনুকূল পরিবেশ নাই।“
আর দুটি কথা এই প্রসঙ্গে না বললেই নয়। বাবাজী তার ‘জীবন পথের পাথেয়’ গ্রন্থের ১১ পাতায় বলেছিলেন – “১০০ জন গৃহস্থের মধ্যে ৩০ জন ভালো গৃহী পাওয়া যায়। কিন্তু, ১০০ জন সাধুর মধ্যে ১ জন ভালো সাধু পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ।“
আবার বাবাজী বলেছিলেন –“মূর্তি পূজার আসল লক্ষ্য আমরা ভুলিয়া গিয়া মদ্য পান করিতেছি। উচ্ছৃঙ্খলতা করিতেছি। ইহা সনাতন ধর্ম নহে।“ (স্বামী সদগুরুদাসজী রচিত বাবাজী মহারাজের জীবন চরিত গ্রন্থের ১৩১ পাতা।)
এমন এক দিনে, এই কথাগুলি লিখছি, যেদিন এই সকালে বাবাজী মহারাজ আমাদের অসহায় অবস্থায় রেখে পার্থিব শরীর ত্যাগ করেছিলেন। আবারও বলছি, ধর্মকে, কে, কীভাবে পালন করবেন, সেটা তার ব্যাপার।
এটা ছিল মেমারীর এক ভাগবত সপ্তাহ এর অনুষ্ঠান
সনাতন ধর্ম, এতো ঠুনকো নয়, সহজেই ভেঙে যাবে। বৈষ্ণবরা পরম সহিষ্ণু। সহিষ্ণুতাই তার আর একটা ধর্ম। কিন্তু, আমরা যেন না ভুলি, আশ্রমের একটা ভাব গম্ভীর পরিবেশ থাকা দরকার। আর একটা বিষয় দেখা দরকার, যেন কারো ভাবাবেগে আঘাত না লাগে।
যাক, সে সব কথা। আজ এমন একটা দিন, যেদিন এই ভারতের বহু গৃহস্থ বাড়িতে পালন করা হচ্ছে বাবাজীর প্রয়াণ দিন।
অনেকে অবশ্য তিথি হিসাবেই এটা পালন করে ফেলেছেন আগেই। কিন্তু, আমরা যেহেতু মহামানবদের সঠিক প্রয়াণ দিবসেই, তার প্রয়াণ দিবস পালনেই অভ্যস্ত, তাই আজকের দিনটিতেই শ্রীবাবাজী মহারাজের প্রয়াণ দিবস হিসাবে পালন করছি। জেনেছি, নূতনগ্রামে বাবাজী মহারাজ প্রতিষ্ঠিত শ্রীশ্রী জানকীদাস কাঠিয়া মহারাজ নামাঙ্কিত তপোবন আশ্রমে ইতিমধ্যেই পালিত হয়েছে বাবাজী মহারাজের প্রয়াণ তিথি। ভাগবত সপ্তাহ হয়েছে।
স্বামী জানকীদাসজী মহারাজ বলতেন – ভগবতপ্রাপ্তি বিষয়ে সাধু ও গৃহীর মধ্যে কোন পার্থক্য নাই।“
কেন বলতেন?
মেমারীর এক ভাগবত সপ্তাহ এর অনুষ্ঠানে বাবাজী মহারাজ
আসলে, যিনি অন্তরে নিঃষ্কাম হবেন, ভালো মানুষ হবেন, তার কাছে গৃহ আর আশ্রমের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। গৃহটা তখন আশ্রম হয়ে ওঠে। বাবাজী মহারাজও এই গৃহী ভক্তদের রাখতেন সবার আগে। কেননা, তিনি বুঝেছিলেন, যারা সংসারের হাজারো কাজ সামলেও নিয়মিত ঈশ্বর আরাধনা করার সময় বের করতে পারেন, তারা অনেক এগিয়ে। বাবাজী তাই বাহ্যিক জটা, দাড়িকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না।
স্বামী সদগুরুদাস রচিত বাবাজীর জীবন চরিত গ্রন্থে বাবাজীর একটা বাণীতে দেখছিলাম লেখা আছে –“সাধু যদি জপ, ধ্যান না করে বা ঈশ্বরকে না ডাকে, তবে কেবলমাত্র বৈরাগী, মহন্ত পদবী বা জটাদাড়ি, বেশভূষার দ্বারা সে যথার্থ সাধু হইতে পারে না।“
‘জীবন পথের পাথেয়’ গ্রন্থে বাবাজী লিখছেন – বৈরাগ্য মানে হলো ঈশ্বরের প্রতি আন্তরিক আকর্ষণের জন্য বিষয়ের প্রতি বিরাগ। কাঠিয়াবাবার ভাষায়, “বিষয় বিষ কর মান।“
গৃহী ভক্তদের মধ্যে সব থেকেও ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা আছে। তাদের সাংসারিক জীবনে ‘রিপু’ থাকার কথা। কিন্তু, সাধকদের তা থাকার কথা নয়।
তারা যদি না রিপু জয়ী হতে পারলো, তাহলে সাধনা কী সম্পূর্ণ হল! যাইহোক, এ সব সাধুদের ভাবনা, তারাই ভাবুক। আমাদের গৃহীদের ভাবনা হলো, কীভাবে ধর্মের পথে থাকবো।
স্বামী সন্তদাসজী বলেছেন –“নিজের বিরুদ্ধ আচরণ দর্শন করিয়াও যখন অন্তরের শান্তি বিঘ্নিত হয় না, তখন তাহাকেই বৈরাগ্য বলে। স্ত্রী-পুত্র-স্বামী তাহারা তাহাদের সংষ্কার লইয়াই চলিবে। ইহাতে বিচলিত হইতে নাই। শান্ত চিত্তে নিরাশী হইয়া কর্তব্য পালন করিয়া যাওয়াই বৈরাগ্য।“
দাদাজী মহারাজের বলে যাওয়া দুটি কথা বাবাজী মহারাজ মাঝে মাঝেই বলতেন।
একটি হল শ্মশান বৈরাগ্য ও অপরটি হলো বিবেক বৈরাগ্য।
শ্মশানে প্রিয়জনকে দাহ করতে দেখে, এই দেহের শেষ দশা চোখের সামনে দেখে আমাদের মনে যেরূপ বৈরাগ্য আসে, দাহ শেষে বাড়ি ফিরে কয়েক দিনের মধ্যেই সেই বৈরাগ্য মন থেকে উড়ে যায়, তাকেই বলা হয় শ্মশান বৈরাগ্য। এটা শ্মশান পর্যন্তই স্থায়ী। এই বৈরাগ্য চিত্ত বিক্ষেপকে শান্ত করতে পারে না।
আর যে বৈরাগ্য মনের মধ্যে সর্বদা ফল্গুধারার মতো বয়ে যেতে থাকে, তাকে বলা হয় বিবেক বৈরাগ্য। বৈরাগ্য যদি চাইতেই হয়, তাহলে বিবেক বৈরাগ্য চাওয়াই ভালো।
দাদাজী মহারাজকে কেউ যদি বলতেন –‘আমি বিবাহ করব না।‘ দাদাজী মহারাজ বলতেন –‘বিবাহ না করে থাকতে পারলে ভালো।‘ কিন্তু সাধু হতেও উৎসাহ দিতেন না।
দাদাজী মহারাজের মতো বাবাজী মহারাজ বিশ্বাস করতেন কর্মযোগের মাধ্যমেই সাধন পথে ভালোভাবে অগ্রসর হওয়াই ভালো। আর কর্মযোগের সাধন গৃহস্থ জীবনেই সুলভ।