অগ্রদ্বীপের নতুনগ্রামে প্রথম পা রেখেই বাবাজীকে শুনতে হয়েছিল শ্লেষাত্মক প্রশ্ন

নতুনগ্রামের প্রথম দিন বাবাজী মহারাজের কাছে ছিল এক পরীক্ষার দিন ও সেই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়ার দিন।
সেটাও ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারী। সালটা ১৯৯৪। বাবাজী মহারাজের তিরোধানের ঠিক ২০ বছর আগের ঘটনা, যেদিন তিনি অগ্রদ্বীপের নতুনগ্রামে প্রথম পা রেখেছিলেন, ধন্য করেছিলেন নতুনগ্রামের মতো একটি পিছিয়ে থাকা গ্রামকে। আর ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪। তিনি শেষবারের মতো ছেড়েছিলেন এই নতুনগ্রাম, অনেক যন্ত্রণা বুকে নিয়ে। 
কেন যন্ত্রণা নিয়ে বলছি, সে সময় এলেই বলবো। আজ নয়। 


 বাবাজীর বৃন্দাবন থেকে এই নতুনগ্রামে আসা যে মহান মানুষটির উদ্যোগে হয়েছিল, তিনি ছিলেন শিশির কুমার ঘোষাল। নবদ্বীপ-বর্ধমান রোড থেকে মাইল খানেক দূরেই সিজনা গ্রাম। সেখানকার বিখ্যাত ঘোষাল পরিবারের বাস। 
শিশিরবাবুর ঐকান্তিক চেষ্টাই নতুনগ্রামের ভাগ্যকে নতুন পথে চালিত করতে সাহায্য করেছিল। 
সেদিন ছিল প্রচন্ড ঠান্ডা। বাবাজীর শরীর ঢেকে আছে তার শ্রীগুরুর দেওয়া চীর বসন। 
বছর দুয়েক আগে শ্রীজানকীদাসজী মহারাজ তার এই প্রিয় শিষ্যের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তার ব্যবহার করা এই বসনটি। এটা তো বসন নয়, সোয়েটার নয়, এ তো শ্রীগুরুর গন্ধ মাখা স্নেহ, তাকে যেন আগলে রেখেছে। 
সম্বলহীন সর্বত্যাগী এই তরুণ সন্ন্যাসীর একমাত্র সম্বল, তার শ্রীগুরুর নির্দেশ- ‘আগামি দিনে তোকে ভক্ত-শিষ্যদের ভার বহন করতে হবে। এর জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে হবে।‘


 নবীন সন্ন্যাসী পা রাখলেন নতুনগ্রামের মাটিতে। গন্তব্যস্থল ঘোষালবাবুদের কাছারী বাড়ি। তখন এই ভগ্নপ্রায় কাছারী বাড়ি ঘন জঙ্গলে পরিপুর্ণ থাকতো। চারিদিকে আম-কাঠালের গাছ। পাখির ডাক। শীতের নরম আলোয় যেন প্রাচীন ঋষিদের ছোট্ট এক টুকরো তপোবন। সত্যি তপোবন। 
পরে, এই কাছারী বাড়ি পরিণত হয়েছিল তপোবন আশ্রমে। ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ দিনে সূচিত হয়েছিল তপোবন আশ্রমের প্রতিষ্ঠা লগ্নের সূত্রপাত। 
 শিশিরবাবু ভেবে পাচ্ছিলেন না, কীভাবে এই বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে এই তরুণ সন্ন্যাসীর বাসযোগ্য করে তোলা যায়। 
তাকে বিভ্রান্ত অবস্থায় দেখে বাবাজী বলে উঠলেন –‘সন্ন্যাসীরা তো আগে গাছতলাতেই থাকতেন। আজ না হয় রাতটা গাছ তলাতেই কাটিয়ে দেব।“ 
শেষপর্যন্ত ঠিক হলো ভগ্ন কাছারী বাড়ির অবশিষ্ট একটা ঘরেই আপাততঃ এই সন্ন্যাসী থাকবেন। ঘোষালবাবুরা এই ঘরটি আগে থেকেই মেরামত ও রঙ করে একটু বাসযোগ্য করে রেখেছিলেন। ঘরে চাবি দেওয়া ছিল, তাই শিশিরবাবু চাবি আনাতে লোক পাঠালেন।


 নিস্তব্ধ এক আশ্রমিক পরিবেশ। দূরে একটা পুকুর। চারিদিকে গাছ-গাছালি। দূর থেকে ট্রেন চলে যাওয়ার শব্দ। আকাশে নীলের হাসি আর মাঠ ভরা হলুদ ফুলের রাশি। সন্ন্যাসী যেন এই জায়গাটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। একটা ছোট্ট গ্রামের মধ্যে যে কী মায়া জড়িয়েছিল, কে জানে! সন্ন্যাসী আপনমনে হেঁটে চলেছেন। সঙ্গে শিশিরবাবু। 
এ পথ সে পথ দিয়ে এসে দাঁড়ালেন একটা বাড়ির সামনে। জনা কয়েক লোক গল্প-গাছা করছিল। শিশিরবাবুকে দেখে তারা এগিয়ে এল। 
শিশিরবাবু তাদের উদ্দেশ্যে বললেন –‘এই সাধুজী বৃন্দাবন থেকে এসেছেন। এখন থেকে এখানেই থাকবেন। তোমরা এনার একটু দেখাশোনা কোরো।“ 
ওই লোকগুলো বাবাজীর মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর কিছু একটা খুঁজে পেয়েছে, এমনভাবে ওদের মধ্যে একজন বলে উঠল – " আপনি কি তিলক-ফোঁটা সম্পর্কে কিছ জানেন?” 


ওদের এই প্রশ্ন শুনে শিশিরবাবু চমকে উঠলেন। সত্যিই তো এই সন্ন্যাসীর ললাট ও ভ্রু-যুগলের মাঝে কী যেন নেই! তারই এলাকায়, তারই পরিচিত মানুষের নির্দয় কথাবার্তায় শিশিরবাবু লজ্জা বোধ করতে লাগলেন। বাবাজী মহারাজ শিশিরবাবুর দিকে তাকালেন। বুঝে ফেললেন তার মানসিক অবস্থা। 
তারপর ওই প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে উঠলেন – আপনারা চেনেন তো বাবুদের ওই কাছারী বাড়ি। আসুন না। আমি তো আপনাদের এখানেই থাকছি। আমি যেটুকু জানি আপনাদের জানাবো, আর যা জানি না তা আপনাদের কাছ থেকে জেনে নেব। 



সকলে নির্বাক। এমন নরমভাবে এই সন্ন্যাসী যেভাবে কথাগুলো বললেন, তাতে সবাই বিষ্মিত। বিভিন্ন সাধুদের আচরণের সঙ্গে তাদের পরিচয় ছিল। তাদের আচরণের সঙ্গে কোন মিলই নেই এই নবীন সন্ন্যাসীর।
 তিনি যেন এই নতুনগ্রামে এসেই জয় করে নিয়েছেন, এখানকার মানুষের হৃদয়। বাবাজী মহারাজ জানতেন বৈষ্ণবের পরম গুণ বিনয়। আর এই বিনয় যার মধ্যে নেই, তিনি কাউকে কাছে টানতে পারবেন না। তাই ওই মানুষদের তীর্যক প্রশ্নকেও সুন্দরভাবে উত্তরের সীমানায় বেঁধে ফেললেন, তার জ্ঞান ও মনের সুরভি দিয়ে। 
নতুনগ্রামের প্রথম দিন বাবাজী মহারাজের কাছে ছিল এক পরীক্ষার দিন ও সেই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়ার দিন। 
 তথ্যঃ শিশির কুমার ঘোষালের 'গুরু সঙ্গে নানা রঙের দিনগুলি'

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad