কুম্ভমেলায় কেনা সোফাতে বসে বাবাজী মহারাজ ঠিক স্বস্তি পেতেন না, তা বলে, কারও দেওয়া ভালোবাসার দানকে তিনি ফিরিয়ে দিতেন না



তারক ঘোষ 

 বাবাজী মহারাজের জন্য বহু শিষ্য-ভক্ত অর্থ বা অন্যান্য জিনিষ নিয়ে আসতেন। বাবাজী সেই সব ভালোবাসার দান গ্রহণ করতেন, কারো মনে দুঃখ দেবেন না বলে। কিন্তু, মনে তিনি ছিলেন একজন খাঁটি সন্ন্যাসী। বিষয়ের মধ্যে থেকেও তিনি ছিলেন বিষয়াসক্তি থেকে অনেক দূরে। ঠিক ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলেছিলেন – পাঁকের মধ্যে পাকাল মাছের মতো থাকতে হয়। পাঁকাল পাঁকে থাকে ঠিকই, কিন্তু পাঁক তাকে স্পর্শ করতে পারে না।
কুম্ভে অমৃত পাওয়া যায়, আবার পাওয়া যায় ‘বিষ’। সমুদ্র মন্থনের সময় বাসুকী নাগের বিষে সমগ্র ধরিত্রী যখন মৃত্যুর পদধ্বনি শুনছে, সেই সময় স্বয়ং মহাদেব এগিয়ে এসেছিলেন ধরিত্রীকে বিষের জ্বালা থেকে রক্ষা করতে। মহাদেব সেই সমুদ্র মন্থনের বিষ পান করে হয়েছিলেন নীলকন্ঠ। আর তারপরে সমুদ্র মন্থনে উঠেছিল অমৃত। আজও কুম্ভে এই দুই এর মিলন।
 কেউ আসেন অমৃত কুম্ভের খোঁজে, কেউ ‘হলাহলে’র সন্ধানে। কারো কপালে জোটে অমৃত, কেউ পান করে বিষ। পাপ আর পূণ্যের মিশ্রণে গড়া মানব জীবন প্রয়াগ সঙ্গমে স্নান করে হয়ে ওঠেন অমৃতের পুত্র-কন্যা। 
এই এলাহাবাদ কুম্ভেই বাবাজীর জন্য কেনা হয়েছিল একটা সোফা আর দু খানা গালিচা। সেবার বাবাজীর সঙ্গে ছিলেন স্বামী বিষ্ণুদাসজী, অমল, শান্তি, কার্তিক আর বাবার একজন প্রিয় শিষ্য মানস। (এই মানস সম্পর্কে আমরা পরে আলোচনা করব।)  এসেছিলেন বাবাজীর বহু ভক্ত-শিষ্য। 
 স্নান পর্বের মাঝে কলকাতা থেকে এসেছিলেন সল্টলেকের স্বপন চ্যাটার্জী, তার স্ত্রী। এই কুম্ভে থাকাকালীন একদিন স্বপনবাবু মেলা থেকে বাবাজীর জন্য নিয়ে এলেন ভেলভেটের কাপড় দিয়ে মোড়া একটা সুদৃশ্য সোফা। বাবাজী সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন। তিনি কুম্ভমেলায় তার তাঁবুতে চটের উপর আসন পেতেই বসতেন। সেটা লক্ষ্য করেই, তিনি ওই সোফাটি কিনে আনেন, যাতে এই শীতে বাবাজীকে মাটিতে বসতে না হয়। তার প্রিয় ‘প্রজ্ঞাদা’র উপর গভীর ভালোবাসা থেকেই তিনি ওটি কিনে আনেন।
বাবাজী মহারাজ সেদিন স্বপনবাবুর এই ভালোবাসার দানকে অগ্রাহ্য করতে পারেন নি। তাই বারবার সোফাটির তারিফ করতে থাকেন, কতো দাম, কোথা থেকে তিনি এটা কিনেছেন, এরকম নানা প্রশ্ন। বাবাজীর এই নানা প্রশ্ন শুনে খুশী হচ্ছিলেন স্বপনবাবু। 
তিনি মনে মনে ভাবছিলেন, এই সোফা পেয়ে তার ‘প্রজ্ঞাদা’ও নিশ্চয় খুশী হয়েছেন। এই মেলাতেই কেনা হয়েছিল দুটি গালিচা। মেলা তখন শেষ লগ্নে। 
আমরা শিশির কুমার ঘোষালের লেখা একটি গ্রন্থে দেখতে পাই – পার্থবাবু একদিন এক গালিচা বিক্রেতাকে ধরে নিয়ে এসে হাজির বাবাজীর কাছে। মেলা ভাঙ্গার সময়, অনেক বিক্রেতাই কম টাকায় শেষ জিনিষপত্র অল্প দামে বেচে ফিরে যান যে যার জায়গায়। সেবার এই রকম এক বিক্রেতার কাছ থেকে কেনা হয়েছিল দুটো গালিচা। দাম পড়েছিল ৮০০ টাকার মতো।। বাবাজীও রাজী হলেন। 
আসলে, তার মনে তখন একটাই ভাবনা। গ্রামের মানুষ আশ্রমে এসে এই গালিচায় বসবেন। ভক্তের ভগবান তিনি, তাই শুধু ভক্তের দিকে তাকিয়েই তিনি করেছিলেন তাদের থাকার আবাস। যাতে আশ্রমে রাত কাটাতে তাদের কষ্ট না হয়। 


আসলে, বাবাজী ভক্তদের দেওয়া অর্থ ভক্তদের জন্য ব্যয় করতেই ভালোবাসতেন। সেই কুম্ভেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। কুম্ভে বাবাজীর ভক্তরা তাকে বেশ কিছু অর্থ প্রণামী দেন। 
কুম্ভ শেষের ঠিক ৩-৪ দিন আগে বাবাজী শান্তি, অমলকে ডেকে বললেন – বেশ কিছু অর্থ বেঁচে গেছে। এক কাজ কর, তোরা বিভিন্ন তাঁবুতে গিয়ে মহন্তজীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে আয়। বলে আয় তাদের জন্য ভান্ডারা দেবার আয়োজন করা হয়েছে। আর তাদের অবশ্যই জানাবি, তারা যেন সশিষ্য এখানে এসে প্রসাদ গ্রহণ করেন। 
সেবার বাবাজীর আহ্বানে বহু আশ্রমের সশিষ্য মহন্তরা এসেছিলেন সেই ভান্ডারায়। বাবাজী তাদের কাছে নিজের জন্য ও তার ভক্তদের জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করেছিলেন।
বাবাজী সেদিন দুটো কথা খুব গুরুত্ব দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। 
একটি হলো – কুম্ভে বেঁচে যাওয়া অর্থ সঞ্চয় করে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক নয় আর দ্বিতীয়টি - আশীর্বাদ পাওয়াটাই হলো অমৃত কুম্ভের সবচেয়ে বড় পাওনা। 
স্বপনবাবু কলকাতা থেকে এলেই বাবাজী মহারাজ সোফাটির ব্যবহার করতেন। আর চলে গেলেই সোফা ফিরে যেত, আগের জায়গায়। বাবাজী ঠিক স্বস্তি পেতেন না। সকলের সামনে সেই সোফায় বসে কথা বলতে তার ভালো লাগতো না। তাই স্বপনবাবু ফিরে গেলেই, তিনি বলতেন – ওরে, এটা তুলে দে।
 সেবার স্বপনবাবু চলে যাওয়ার পরও সোফাটা পাতা ছিল। 


তাই দেখে বাবাজী বলেছিলেন- স্বপনবাবু তো সকালেই চলে গেছেন, তবে, সোফাটা আবার পেতে রেখেছিস কেন? তোদের এক কথা কেন বারবার বলতে হয়? জায়গা জোড়া হয়ে যাচ্ছে, কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে। 
 সেদিন কোন এক ব্যক্তির মনে ওই সোফাটি দেখে বেশ কিছু প্রশ্ন এসেছিল। তার মনে হয়েছিল, আর্থিক উন্নতির সঙ্গে বাবাজী মহারাজকে বস্তু ধর্ম গ্রাস করছে। তার উত্তর তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন। বাবাজী বস্তুর মধ্যে থেকেও ছিলেন পার্থিব বস্তু থেকে অনেক দূরে। তার সন্ন্যাস শুধু বাইরে ছিল না, ছিল মনে। আসলে, বাবাজী বিশ্বাস করতেন, যিনি মনে সন্ন্যাসী, তিনিই আসল সন্ন্যাসী। তিনি সাধুই হোন, কিংবা গৃহী।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad