এই লেখার বেশ কিছু তথ্য নেওয়া হয়েছে শিশির কুমার ঘোষালের ‘গুরু সঙ্গে নানা রঙের দিনগুলি’ গ্রন্থ থেকে। এই লেখক তার লেখার কাছে কৃতজ্ঞ।
একদিন বৃন্দাবন আশ্রমে দাদাজী মহারাজ বাবাজীকে মন্দিরের দরজাটা পরিষ্কার করতে বললেন। অ্যাসিড জাতীয় পদার্থ দিয়ে বাবাজী দরজাটা পরিষ্কার করছিলেন। এইভাবে পরিষ্কার করতে করতে বাবাজী মহারাজ দেখলেন রূপার পাতের মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণ পরিষ্কার করার পর বাবাজী দেখলেন রাধা-কৃষ্ণের একটা চিত্র।
শ্রীজানকীদাসজী বাবাজীকে জিজ্ঞাসা করলেন – ‘তুমি চিত্রটিকে কি বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছিলে?’ বাবাজী বললেন –‘না বাবা, কিন্তু চিত্রটি ওখানে ছিল।‘
দাদাজী মহারাজ বললেন – ‘কেন তুমি দেখতে পাচ্ছিলে না?’
বাবাজী জানালেন – ‘দরজায় এত ময়লা জমে গিয়েছিল যে চিত্রটি তাতে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।
শ্রীজানকীদাসজী তখন বাবাজীকে বলেন – ‘এটাই তোমার হৃদয়ের ঘটনা। ওখানে এত ময়লা জমে আছে যে তোমার হৃদয়স্থিত ভগবানকে তুমি দেখতে পাচ্ছ না। হৃদয়ের ময়লাকে পরিষ্কার কর। তোমার ভগবান তোমার কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়বে।‘
আসলে ভগবান আর কোথাও থাকেন কি না আমি জানি না। আমিও বিশ্বাস করি, ভগবান প্রত্যেকের হৃদয়ে থাকেন। বাউল জগতে তাই এই ঈশ্বর তথা ‘মনের মানুষের’ সাধনা চলে নিজের ‘প্রতিবেশী’কে খোঁজার মধ্য দিয়ে।
নিজের মনে যদি লোভ, কামনা-বাসনার পাহাড় জমে থাকে, ঈশ্বরকে দেখা বা উপলব্ধি করা যায় না।
দাদাজী মহারাজ হঠাৎ বৈরাগ্যকে খুব একটা প্রাধান্য দিতেন না। তার মতে, শাস্ত্র নিয়ম অনুযায়ী অন্ততঃ ৬ বছর থেকে ১২ বছর অতিক্রান্ত না হলে তাকে সন্ন্যাস দীক্ষা দেওয়া যায় না।
এই সময়টা তাকে ব্রম্ভচারী হয়ে গুরুসেবা বা আশ্রমে নিযুক্ত থাকতে হয়।
কিন্তু, এখন বদলে গেছে, আশ্রমের আপাত-মধুর টানে অনেকেই হঠাৎ সন্ন্যাসী হয়ে যাচ্ছেন। মনোভূমি তৈরি হওয়ার আগে, কামনা-বাসনার আধারেই পোঁতা হচ্ছে দীক্ষার বীজমন্ত্র। যারা নিজেরাই সিদ্ধ হয়ে উঠতে পারেনি, সংস্কারের মধ্যেই বন্দী, তারা কীভাবে অন্যকে দেখাবেন মুক্তির পথ।
তফাৎ সেই কাঁচায় আর পাকায়।
সেবার আসামে কাঠিয়া সম্প্রদায়ের বিরাট মাপের মহন্তদের নিয়ে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ওখানকার স্থানীয় মহন্ত সকলকেই আমন্ত্রন জানিয়েছেন। উপস্থিত থাকছেন সুখচরের বৃন্দাবন বিহারী দাসজী, আসছেন বৃন্দাবন থেকে সশিষ্য রাসবিহারী দাসজী।
বাবাজী মহারাজজীও থাকছেন সেখানে। যে কোন কারণে সেবার বড়র আশ্রমের অমরদাসজী আসতে পারছেন না।
এ এক অদ্ভুত ধর্ম সম্মেলন। শ্রোতারা মন্রমুগ্ধের মতো শুনছেন কাঠিয়া সম্প্রদায়ের স্বনামধন্য মহন্তদের কাছ থেকে দর্শন ও ধর্মের ব্যাখ্যা।
কেউ বাংলায়, কেউ বা সংষ্কৃত ভাষায় তাদের বক্তব্য রাখছেন। উপস্থিত শ্রোতারা কেউ বুঝতে পারছেন, কেউ পারছেন না। কিন্তু, সকলের মধ্যেই জানার একটা তীব্র ইচ্ছা চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে।
একপাশে বসে রয়েছেন শ্রীপ্রজ্ঞাদাসজী। গভীর মনযোগ দিয়ে তিনি শুনে চলেছেন অন্য সন্ন্যাসীদের দর্শন।
এরপর স্বামী শ্রীপ্রজ্ঞাদাসজী অর্থাৎ বাবাজী বলতে উঠলেন। তার বলার ধরণ, সহজ বাক্যের ব্যবহার ও দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়ে শ্রোতাদের কাছে এক নতুন জগতের দ্বার উন্মোচিত করলেন। শ্রোতারা শুনছেন একমনে।
তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ এই অসামান্য সন্ন্যাসীর শান্ত মুখশ্রীতে। যারা বাবাজীর কথা শুনেছেন, তারা জানেন, বাবাজী সহজ কথায় ধর্মের জটিল তত্বকে সাধারণ মানুষের আছে সহজভাবে তুলে ধরতেন। চলমান জীবনের নানা ঘটনা উঠে আসত তার উপমায়।
কুসংষ্কার বর্জিত ধর্মের কথাই তিনি বলতেন, যে ধর্ম মানুষকে খারাপ থেকে ভালোর দিকে নিয়ে যাবে, সেই ধর্মের কথা তিনি বলতেন। বলতেন কপটতা ও শঠতা ত্যাগ করার কথা। সেদিন বাবাজী মহারাজের বলা কথা উপস্থিত শ্রোতাদের অন্তর ছুঁয়ে গিয়েছিল।
আসলে, বাবাজী মহারাজ আর একটি উপদেশ আমাদের দিয়ে গেছেন। সেটি হলো – গুরুতে ভেদ করতে নেই।
‘উনি আমার গুরুদেব নন – ওনার কথা আমি বলব না।‘ এই ভাবনা ঠিক নয়। তিনি শুধু কাঠিয়া সম্পদায়ের অন্যান্য গুরুদের যথাযথ সম্মান দেখাতেন, তাই নয়, নিজের স্কুল-কলেজ ও ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদেরও নিজ গুরুজ্ঞানে প্রণাম জানাতেন, সম্মান করতেন। তার এই আদর্শ আমি জানিনা আমাদের কতজনের মধ্যে আছে।
যাইহোক।
সভা শেষ হওয়ার পর উপস্থিত ভক্তরা শ্রীপ্রজ্ঞাদাসজীকে প্রণাম জানানোর জন্য রীতিমত হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিলেন। পরের দিন আসামের স্থানীয় সংবাদপত্রে এই সন্ন্যাসীর সহজ-সরল ভাষায় ধর্মের জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা প্রকাশিত হলো।