বাবাজী মহারাজ বলছেন, শ্রী জানকীদাসজী মহারাজ, শ্রী ধনঞ্জয়দাসজী মহারাজের দেওয়া একটি কবচ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধারণ করেছিলেন।‘

এই মহাপুরুষদের জীবনে শ্রীগুরুই ছিলেন একমাত্র আদর্শ। শ্রীগুরুর আজ্ঞা বহন করে, তাকে অনুসরন করেই যাবতীয় পার্থিব কর্ম করে গেছেন তারা। ঈশ্বর আরাধনার জগতে একজন সদগুরুর ভূমিকা কী। এনাদের জীবনই তার উত্তর
শ্রী ধনজয়দাসজী মহারাজ শ্রী জানকীদাসজীকে একবার বলেছিলেন – ‘উঠিবে পড়িবে, জীবন অমৃতময় হবে। আগে বিষ পরে অমৃত।‘ 
শ্রীবাবাজী মহারাজের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, শ্রী ধনঞ্জয়দাসজী শ্রী জানকীদাসজীকে আশ্রমের বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যে ফেলে, আগুনে পুড়িয়ে খাটি সোনায় পরিণত করেছিলেন। একবার শ্রীদাদাজী মহারাজ শ্রী ধনঞ্জয়দাসজী মহারাজকে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি কি তার কোন কাজে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। 
এর উত্তরে শ্রী ধনঞ্জয়দাসজী লিখেছিলেন – ‘তোমার উপর আমি কখনো অসন্তুষ্ট হয়েছি বলে মনে পড়ে না। যদি হয়ে থাকি, তবে সেটা তোমার চিত্ত শুদ্ধির জন্য।‘ 


 শ্রী ধনঞ্জয়দাসজী মহারাজকেও অনেক কটূকথা শুনতে হয়েছিল। কিন্তু, সেই বিরুদ্ধ পরিবেশের মাঝে থেকেও, তিনি যে আচরণ করে গেছেন, তা একমাত্র মহাপুরুষরাই পারেন। 
আশ্রমের অভ্যন্তরিক কলহ এমন আকার ধারণ করেছিল যে, শ্রী ধনঞ্জয়দাসজী মহন্তের পদ ত্যাগ করবেন বলে স্থির করে নেন। কমিটির কয়েকজন তার কাছে পদত্যাগ পত্র দাবী করেন। শ্রী ধনঞ্জয়দাসজী একমুহুর্ত চিন্তা না করে লিখে দেন পদত্যাগ পত্র। 
এরপর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে এই বিষয়ে সাময়িক একটা মীমাংসা হয়। বাবাজী মহারাজের লেখা থেকে জানতে পারি, শ্রী ধনঞ্জয়দাসজী মহারাজের পক্ষীয় আশ্রম কমিটি শ্রী ধনঞ্জয়দাসজীকে মহন্ত পদ থেকে সরানোর জন্য আদালতে মামলা করেন। আর শ্রী জানকীদাসজীর উপর দায়িত্ব পরে তা দেখভাল করার।
আমরা দেখতে পাই, এই মামলা চলার সময় শ্রীদাদাজী মহারাজ আদালতে উকিলের পায়ের নীচে বসে আছেন আর সেই উকিল তাকে বলছে –‘ক্যা বাবাজী থুক ফেককে, ফির চাটনে কে লিয়ে আয়া? থুতু ফেলে আবার থুতু চাটতে এসেছেন। 
তারা বলতে চাইতেন – সব কিছু বিষয় ত্যাগ করে সাধু হয়েছেন, আবার সেই বিষয়ের জন্য মামলা করতে এসেছেন? এসব কথা শ্রীদাদাজী মহারাজকে অনেক শুনতে হয়েছে। কিন্তু, তিনি গায়ে মাখেন নি। শুধু গুরুবাক্য পালন করে গেছেন মনে-প্রাণে। 
কারণ, গুরুসেবাই এই সমস্ত মহামানবের আদর্শ ছিল। শ্রীজানকীদাসজী, শ্রীবাবাজী মহারাজজী এর ব্যতিক্রম নন। 
 শ্রী জানকীদাসজীকে দেখে অনেক উকিল বলতেন – এই বাবাজী মামলার বাবাজী নন। জানা যায়, শ্রীদাদাজী মহারাজ সকালে যেতেন আদালতে, আর সেখান থেকে আশ্রমে ফিরতেন রাত ৮ টা নাগাদ। এটাই ছিল তখন তার একমাত্র কাজ। 
একজন সন্ন্যাসী হয়েও এই বিষয় সংক্রান্ত কাজ করতে হওয়ায় তিনি শ্রী ধনঞ্জয়দাসজী মহারাজকে এর কারণ জানতে চান। পরে শ্রী জানকীদাসজী লিখেছিলেন – ‘আমি মামলায় যেতে চাইনি, কিন্তু বাবা আমাকে পরম্পরার অনেক গুপ্ত রহস্যের কথা বুঝিয়ে বলার পর আমি অবনত মস্তকে তার আদেশ পালন করতে শুরু করি।‘ 
এই প্রসঙ্গে শ্রীসন্তদাসজীর একটা কথা না বললেই নয়। শ্রীসন্তদাসজী বলেছিলেন – ‘লেগে থাক, পরিচয় তিনিই দিতে থাকবেন।‘ 
একবার এই মামলা চলাকালীন শ্রী ধনঞ্জয়দাসজী শ্রীদাদাজী মহারাজকে বলেন – ‘তোমাকে বিরুদ্ধ পরিবেশে, নানা লোকজনের সঙ্গে মিশতে হয়। আমার মাঝে মাঝে ভয় হয়। তোমাকে যদি একটা কবচ দিই, তুমি কি সেটা ধারণ করবে?’
শ্রীজানকীদাসজী পূর্বাপর চিন্তা নাকরেই বলেছিলেন, ‘আপনার যা ইচ্ছা আমি সেটাই করব।‘ শ্রী ধনঞ্জয়দাসজীর দেওয়া সেই কবচ শ্রীজানকীদাসজীর সারা জীবন এমনকি মৃত্যুর সময়েো তার অঙ্গে ছিল। এটাই গুরুভক্তি। 
আর আমাদের বাবাজী মহারাজও ছিলেন সেই পথের পথিক। তিনি ছিলেন শ্রীজানকীদাসজীর প্রতিচ্ছবি। নানা অসম্মান সহ্য করেও শুধু গুরুমুখী হয়ে তার কর্ম করে গেছেন। তার নির্দেশ মেনে গেছেন অক্ষরে অক্ষরে। 
বাবাজী মহারাজের লেখা থেকে জানতে পারা যায় – ১৯৫৩ সালের ২২ মার্চ শ্রী ধনঞ্জয় দাসজী মস্তক মুন্ডন করেন এবং নিয়ম করে ভজনে নিবিষ্ট হন। তিনি তখন দেরাদুনের রায়পুরে। যেখানে তিনি থাকতেন, সেই জায়গাটা স্টেশন থেকে মেইল চারেক দূরে। নির্জন, চারিদিকে পাহাড়, জঙ্গল আর প্রকৃতির অসীম সৌন্দর্য্য। সেই সময় শ্রীজানকীদাসজী টেলিগ্রাম পেয়ে সেখানে পৌছান। দেখেন তার শ্রীগুরুজী মস্তক মুন্ডন করে বিষণ্ণ বদনে বসে আছেন। 
তাকে এই অবস্থায় দেখে শ্রীদাদাজী মহারাজে চোখ ফেটে জল আসতে থাকে। বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করে শ্রীগুরুকে প্রণাম করে নিজের কর্তব্য স্থির করে নেন। 
ঈশ্বরের ভাবনা ঈশ্বরই বোঝেন। শ্রী ধনঞ্জয়দাসজী ও শ্রীজানকীদাসজী ভেবেছিলেন নির্জন প্রকৃতির কোলে গিয়ে সাধন-ভজন করেই কাটিয়ে দেবেন বাকি জীবন। কিন্তু ভগবানের সেই ইচ্ছা ছিল না। তাই লোকশিক্ষার জন্যই তাদের থাকতে হল সেই সমাজের মাঝেই।

 

শ্রীজানকীদাসজী বলেছিলেন, সাধক কোনদিন প্রতিজ্ঞা করেন না। কেননা সাধকের সব কিছুই ভগবানের শ্রী চরণে নিবেদিত। বাবা কেবলমাত্র তার অন্তরের আবেগ প্রকাশ করেছেন। আবেগের বশে ব্যক্তি শ্রী ধনঞ্জয়দাসজী কুম্ভে না যেতে পারেন, কিন্তু মহন্ত শ্রী ধনঞ্জয়দাসজীকে কুম্ভে যেতে হবে কর্তব্যের খাতিরে।‘ 
 শ্রীদাদাজী মহারাজ বলতেন – কুম্ভমেলায় গিয়ে আমরা আত্মসমীক্ষার সুযোগ পাই। বিষয়ের নাগপাশ আর রুটিনবদ্ধ জীবনের দমবন্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তি লাভ করি। দেহরূপ কুম্ভের মধ্যে যে অমৃতরূপ আত্মা আছে, সেই আত্মার মধ্যে যে যথার্থ শান্তি আছে, তার সন্ধান করি।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad