দ্বাদশ বছরে পদার্পণের আগেই তার সঙ্গে দেখা হয় ভারতের সাধুসমাজের আর এক শিরোমণি স্বামী জানকীদাস কাঠিয়া মহারাজের সঙ্গে। আর তখন থেকেই তার পথ বদলে যায়। পরবর্তীকালে এই সাধক শ্রীশ্রী ধনঞ্জয় দাসজী কাঠিয়া মহারাজের শিষ্য শ্রীশ্রী স্বামী জানকীদাসজী কাঠিয়ার কাছে সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন।
ধর্মের পথে অগ্রসর হলেও শিক্ষার দিকে ছিল স্বামী প্রজ্ঞাদাসজীর এক অমোঘ টান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত এই সাধক ১৯৮১ সালে দর্শনে স্নাতক হলেন বর্ধমানে রাজ কলেজ থেকে।
১৯৮৩ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে স্বর্ণপদক নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করলেন। যদিও, সে বছরের পরীক্ষা বিশেষ কারণে ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৮৫ সালের ২৯ মার্চ তার সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষা হয়। প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় থেকে তিনি এদিন পরিচিত হলেন স্বামী প্রজ্ঞাদাস নামে।
তার গুরুদেব স্বামী জানকীদাসের ইচ্ছানুসারে তিনি এরপর হাত দেন গবেষণার। গবেষণার বিষয় ছিল কার্ল মার্ক্স ও নিবার্ক মতবাদের তুলনা। ১৯৯১ সালে তিনি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার গবেষণার স্বীকৃতি হিসাবে লাভ করেন ডক্টরেট ডিগ্রি। তার থিসিসের নাম ছিল – A Society in the thought of Marx and Nimbarka”
তার এই গবেষণা ভারতীয় সমাজতত্ববিদদের কাছে এক নতুল আলো। এই মহামানব এর পর ব্রতী হলেন গুরু আজ্ঞা পালনের মধ্য দিয়ে সাধন পথে অগ্রসর হতে। পরবর্তীকালে তিনি তার গুরুদেবের নামে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব বর্ধমানের অগ্রদ্বীপের কাছে নূতনগ্রামে।
এরপর তিনি একের পর এক কর্মযজ্ঞে লিপ্ত হয়ে পড়েন। গ্রামের উন্নতি সাধনের পাশাপাশি তিনি স্থাপন করেন উচ্চ-বিদ্যালয়, লাইব্রেরীসহ একাধিক জন-কল্যাণমূলক কাজ।
পাশাপাশি রচনা করেন একাধিক গ্রন্থ। তার রচিত গীতার ভাষ্য ‘গীতা চিরন্তন’ ভারতীয় হিন্দু সমাজের কাছে সাদরে গৃহিত হয়। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয় এর ইংরাজী সংষ্করণ। ২০১১ সালে তিনি নূতনগ্রাম তপোবন আশ্রমে নির্মান করান শ্রীরাধাকুঞ্জবিহারীজীর নূতন মন্দির।
শ্রীশ্রী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া মহারাজ সন্ন্যাসী হয়েও বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের মেল-বন্ধনের কথা বলে এবং জাতিভেদপ্রথার নূতন ব্যাখ্যা দিয়ে ভারতীয় ধর্মীয় সমাজে এক নূতন দিগন্ত আনেন। তার নূতনভাবে সমাজচিন্তা ভবিষ্যতের সমাজতত্ববিদদের কাছে এক গবেষণার বিষয়।
যে দিনটি আমাদের চেতনার গভীরে ভয়ঙ্করভাবে আঘাত করেছিল, সেই দিনটি অর্থাৎ ২৮ ফেব্রুয়ারী আগতপ্রায়। এই দিনটিতে আমরা বাবাজী মহারাজের পার্থিব শরীরকে হারিয়েছি। কিন্তু, ২০১৪ থেকে ২০২৩ এ এসে উপলব্ধি করেছি – সময় এই মহান সন্ন্যাসীর কাছে পরাভূত – মৃত্যু, জীবনের পরিণতি হলেও, মৃত্যুই শেষ কথা বলে না। যিনি বিশ্ব-ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথের একজন বিমুগ্ধ পাঠক ছিলেন, তিনি যেন সেই দিন বলে গেলেন –
‘আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়’ এই শেষ কথা বলে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব বাংলার নবজাগরণে জ্বালিয়েছিল এক আগুনের শিখা। তার লোকশিক্ষা মানুষকে পরিশোধিত হবার রাস্তা দেখিয়েছিল। তার ভক্ত বীর-সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ, তার দেখানো পথকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন জ্ঞানের আলোয়; ঠিক তেমনি স্বামী জানকীদাসজী মহারাজও এসেছিলেন লোকশিক্ষা দেওয়ার জন্য।
এই যোগীশ্রেষ্ঠ সাধক নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের পূর্বতন সন্ন্যাসীদের আদর্শকে মাথায় রেখে, প্রয়োজনে নিজস্ব চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য। আর তার মহাপ্রয়াণের পর তার আর এক সুযোগ্য শিষ্য স্বামী প্রজ্ঞাদাসজী মহারাজ, তার জ্বালিয়ে যাওয়া মশালের আলোয় আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
তার চলা থেমে গেছে, কিন্তু পথ যেমন শেষ হয়নি, তেমনি শেষ হয়ে যায়নি তার আদর্শ। তার জ্ঞান তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন, তার ভক্ত-শিষ্যদের মাঝে। কেউ না কেউ, আবার হাতে তুলে নেবে সেই চেতনার মশাল, আবার জ্বলে উঠবে আলো, আবার শুরু হবে তার দেখানো পথে চলা।
কিন্তু, শ্রীবাবাজীকে বুঝতে হলে, চেতনার ঘুম ভাঙাতেই হবে। চেতনাই পারে মানুষকে সঠিক পথে চালাতে। আজ মনে পড়ছে গান্ধীজীর অকালপ্রয়াণের পর লেখিকা নয়নতারা সেহগালের লেখা কয়েকটি কথা –
“I felt the magic circle had vanished, leaving me unprotected.”
বাংলা অর্থ – আমি অনুভব করলাম, আমাকে অরক্ষিত রেখে সেই যাদু-বলয়টা হারিয়ে গেল।“
কিন্তু, তারপর তিনি লিখছেন –
“What if now Bapu is gone. We were still there, young, strong and proud to bear his banner before us.” এখন যদিও বাপুজী চলে গেছেন, কিন্তু আমরা আছি এখনো, যুবক-যুবতী, সামর্থ্যবান, গর্বিত; তার ধ্বজা বহন করার জন্য।“
সেই ‘ম্যাজিক সার্কেল’ আজও আমাদের ঘিরে রেখেছে। ধর্ম, শিক্ষা, বিজ্ঞান-মনষ্কতা আর পিতার স্নেহে, তিনি আমাদের ঘিরে রেখেছেন। আমাদের চেতনার গভীরে তিনি আজও আমাদের ঘুম ভাঙানোর কাজ করে চলেছেন। তিনি আমাদের কাছে এক মসীহা, অগ্রদূত।
বাবাজী একজায়গায় তার শ্রীগুরু প্রসঙ্গে বলছেন –
“যে কোন কাজ তিনি ধরতেন, তা শেষ না করে ছাড়তেন না। এটা ছিল তার বাহ্য ব্যবহার। লোকচক্ষুর আড়ালে কতভাবে কত ভক্ত শিষ্যের অধ্যাত্ম উন্নয়ন ত্বরাণ্বিত করতেন, তার সব খবর কারো জানা নেই।“