দীক্ষা নেওয়ার আগে বহু শিষ্য যেমন গুরুকে পরীক্ষা করে নেন, ঠিক তেমনই গুরুও শিষ্যকে পরীক্ষা করে নেন। শিষ্যের মনোভূমি বীজ বপনের অনুকূল না হলে, সেখানে বীজ বপন করেও লাভ হয় না। তাই, সত্যিকারের সদগুরু, সহজে মন্ত্র-দীক্ষা দিতেও চান না।
আমি বাবাজী মহারাজকে বহুবার মন্ত্র-দীক্ষা নিতে আসা মানুষজনকে সরাসরি ‘না’ বলে দিতে শুনেছি। আবার দেখেছি বহু মানুষ দীক্ষা নেওয়ার জন্য রীতিমতো ‘দড়ি-টানাটানি’ করছেন। শেষ একান্ত নিরূপায় হয়েই বাবাজী তাদের দীক্ষা দিয়েছেন যেমন, তেমনই বলেও দিয়েছেন – গুরুকে দিয়ে জোর করে কিছু করাতে নেই। জোর করে কোন কাজ করানো হলে, বা বলানো হলে, সেই কাজ বা বলা কোন সুফল দেয় না। শ্রী জানকীদাসজীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তিনি বলেছেন –মহাপুরুষ হলেই যে গুরু হবেন, এমন কথা নাই। গুরু হতে পারেন, আবার মহাপুরুষ নাও হতে পারেন। আবার মহাপুরুষ হতে পারেন, গুরু নাও হতে পারেন। কেউ বা গুরু-মহাপুরুষ দুইই হতে পারেন।
শিষ্য কেমন হবেন, এ নিয়ে বাবাজী মহারাজ, শ্রীজানকীদাসজী মহারাজ বহু গ্রন্থে বহুবার আলোচনা করেছেন। আর এই আলোচনা থেকে আমার মনে হয় শিষ্যের মধ্যে এই দুটি গুণ অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। প্রথমটি হলো গুরুবাক্যে অটল বিশ্বাস আর দ্বিতীয়টি হলো- গুরু-বাক্যে নির্দেশিত কর্ম করে যাওয়া।
অটল বিশ্বাস রাখা গৃহী মানুষের কাছে খুব একটা সোজা ব্যাপার নয়। বিশ্বাস অটল হয় তখনই, যখন নিজে কর্তা না সেজে ভৃত্য সাজা হয়। সোজা কথায় যন্ত্র-বাদক না সেজে বাদ্য-যন্ত্র সাজা। কেউ হয়তো, কোন বিপদ (সেটা সাংসারিক হতে পারে, ব্যক্তিগত হতে পারে) থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য গুরুকে ডাকলেন।
কিন্তু, দেখা গেল, তিনি কিন্তু বিপদ থেকে রক্ষা পেলেন না। তার সেই বিপদ হলো। তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেকেই গুরুর কাছে কিছুটা অভিমানের স্বরে প্রতিবাদ করে বসেন।
যে শিষ্য গুরু-অন্তপ্রাণ, তার জীবনেও বিপদ আসে। আর সেটা আসে তার ভালোর জন্য। ক্ষেত্রবিশেষে, তাকে পরীক্ষা করার জন্য, কখনো বা কোন বড় বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য ছোট বিপদের মধ্য দিয়ে শিষ্যকে পাঠানো ।
শ্রীবাবাজী মহারাজকেও অনেক নিন্দা-অপমান সহ্য করতে হয়েছিল। আর এই নেগেটিভ শক্তি বাবাজী মহারাজের মধ্যে পজিটিভ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। শ্রীজানকীদাসজী তখন অসুস্থ। বাবাজী মহারাজ নিজে তার খাওয়া-শোয়া-বসা এর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। একদিন তিনি দাদাজী মহারাজের শরীরের দুপাশে পা দিয়ে তাকে ওঠানোর চেষ্টা করছিলেন। কোন একজন ভক্ত বাবাজীকে বলেছিলেন – ‘তুমি তো মহাপাপী, নরকেও তোমার স্থান হবে না।‘
এটাই শিষ্যের কর্তব্য। সংষ্কারকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে বাস্তব জ্ঞান হারালে চলে না। গুরুকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব প্রথম, তারপর সংষ্কার। বাবাজী মহারাজ নিজ হাতে গুরুর অসুস্থ অবস্থায় শৌচ করিয়ে দিতেন। নির্বিশেষ গুরুবাক্য পালনই তার ধর্ম ছিল। তিনি কোথাও নিজের কথা বলেন নি, গুরুর কথাই প্রচার করে গেছেন। গুরুর আদর্শকে ধরে রেখে গুরুবাক্য পালন করে গুরুর কথাই প্রতিটি জায়গায় ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন।
এমন কোন প্রবচন অনুষ্ঠান নেই, যেখানে তিনি তার শ্রীগুরুর কথা বলেন নি।
আর একটি জিনিষ তার মধ্যে দেখা যেত, সেটা হলো জ্ঞানের দীপ্তি। যেটা তার কণ্ঠে, চোখে-মুখে ফুটে উঠত। তার বলিষ্ঠ-মধুর জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য, তার দীপ্ত চেহারা, তাকে দিয়েছিল এক সত্যিকারের জ্ঞানী ঋষির চেহারা।
আমি আবার বলি, সবাই সাধক বামাক্ষ্যাপা বা শ্রীরামকৃষ্ণ হন না। জনগণের মাঝে ধর্মের কথা বলতে জ্ঞান ও ব্যাপক পড়াশোনা লাগে। নইলে সেরকম নাছোড়বান্দা শিষ্যের বা ভক্তের কাছে পড়লে গুরুও নির্বাক হয়ে পড়তে পারেন। তাই সত্যিকারের গুরু হতে হলে জ্ঞানী হতে হবে।
নিজের জ্ঞান, চেতনা ও ধর্ম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকলে বা বাগ্মী হতে না পারলে, তিনি শিষ্যদের অন্তরে স্থায়ী আসন পেতে পারেন না। দেখামাত্র ভক্তি আর ‘শাশ্বত ভক্তির মধ্যে একটা পার্থক্য আছে।
বাবাজী বলছেন – ব্রম্ভনিষ্ঠ গুরু শিষ্যের সব কিছু গ্রহণ করে শিষ্যকে পথের কাঙ্গাল করেন না। আর যদি তাই করেন, তাহলে অম্লান বদনে তা সহ্য করতে হবে। ভগবানকে লাভ করতে হলে কিছু পরীক্ষা তো দিতেই হবে।
শিষ্যের সবকিছু গুরুতে অর্পন করতে হবে। শিষ্যের নিজের যেটা সবচেয়ে প্রিয়, সেই ‘আমি’টাও গুরুকে দান করতে হবে। সেই ‘আমি’টাও তখন ‘তুমি’ হয়ে যাবে। আর এটা করতে পারলেই শিষ্যের কর্তব্য শেষ হয়। তখন আরম্ভ হয় গুরুর কর্তব্য।
সহজ কথায় বলতে গেলে, কোন কিছু না ভেবেই নিজেকে গুরুর পায়ে পূর্ণ সমর্পণ করতে হবে।
বাবাজী মহারাজ বলছেন – গুরু শিষ্যকে কি জিনিস দেন, জানো?
তিনি শিষ্যকে এমন জিনিস দেন, পৃথিবীর কোন জিনিস তার বিনিময় হতে পারে না। গুরু শিষ্যকে আত্মদান করেন। নিজে মরে শিষ্যকে বাঁচান। শিষ্যকে তিনি দান করেন এক চির আনন্দ। শিষ্যের সুখেই গুরুর আনন্দ। শিষ্যের মধ্যে যা কিছু মলিনতা, যতকিছু সন্তাপ, পাপ – সব নিজে গ্রহণ করে শিষ্যকে দেন এক পবিত্র আলোকশিখা।