আমি বহু সাধু-সন্ন্যাসীকে বলতে শুনেছি – ‘নারী নরকের দ্বার।‘ বহু শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত মানুষকেও দেখেছি এখনো নারীদের তারা মানুষ ভাবতেই পারে্ন নি।
বহু পিতা-মাতা কন্যার বিবাহের সময় বলেন, ‘শ্বশুড়বাড়িটাই তোর আসল বাড়ি।‘ বহু নারীকে আজও প্রথম জীবনে পিতা, পরে স্বামী ও শেষ জীবনে পুত্রের উপর নির্ভর করেই থাকতে হয়।
খুব কম নারীই এই জীবনে তাদের আসল বাড়ি খুঁজে পান।
আজও নারীদের, কিশোরীদের, শিশু-কন্যাদের ধর্ষিতা হতে হয়। তাদের কান্না হারিয়ে যায় রাজনীতির চোরা স্রোতে।
তবু সমাজ এগিয়ে চলে, এক নারীকে অসম্মান করে, অন্য নারীতে প্রেম খোঁজে। এটাই আমাদের দ্বিচারিতা।
আজ এই প্রতিবেদনে আমি দেখানোর চেষ্টা করছি, আমাদের বাবাজী মহারাজ নারীদের কোন চোখে দেখতেন। তিনি ভারতের নারীদের সম্পর্কে কী বলে গেছেন। একজন সন্ন্যাসী হয়েও কেন তিনি নারীদের পদসেবা গ্রহণ করতেন – এসব কিছু।
এই প্রতিবেদন আরম্ভ করার আগে বাবাজীর দেওয়া গীতার একটি শ্লোকের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি কী বলেছেন দেখে নেওয়া যাক।
প্রথমেই বলেছিলাম, অনেক সাধু-সন্ন্যাসীকে বলতে শুনেছি- নারী নরকের দ্বার। আর বাবাজী মহারাজ বলছেন, কাম, ক্রোধ ও লোভ – এই তিনটি হল নরকের দ্বার। কাম জয় করলেই প্রেমের আবির্ভাব হয়। কিন্তু, দেখা যায়, যে নারীপ্রতিমা মাতৃস্বরূপা, কন্যারূপা – তাদের সেইরূপে না দেখে উপভোগের দৃষ্টিতে দেখা হয় অনেক সময়। প্রথমে নানাবিধ মায়া, অভিনয় দিয়ে সেই নারীমন জয় করার চেষ্টা হয়। সফল না হলে পশুবল প্রয়োগ করে নিজের পাশবিক ক্ষুধা চরিতার্থ করে।
আর এই ভোগে বাধা পড়লে, কামুক হৃদয়ে সৃষ্টি হয় ক্রোধের সঞ্চার। সেই ক্রোধের বশবর্তী হয়ে, সে তখন নানারূপ পৈশাচিক কাজে লিপ্ত হয়। অপরের সম্পত্তি আর স্ত্রী নিজের নিজের অধিকারে আনার যে ইচ্ছা, সেটাই লোভ।
বাবাজী মহারাজ নারীদের দেখতেন মাতৃরূপে আর কন্যারূপে। তাদের মধ্যে তিনি দর্শন করেছেন দেবী দুর্গার অসুরনাশিনী ও মাতৃরূপ। নারীদের তিনি দেখেছেন লক্ষীরূপে, সরস্বতী রূপে। তিনি, কন্যারূপা নারীদের পদসেবার সূযোগ দিয়েছিলেন।
বাবাজী মহারাজের আগে, আমরা যদি ফিরে যাই, শ্রীশ্রী রামদাসজী কাঠিয়াবাবার সময়ে, আমরা কী দেখতে পাই? শ্রীরামদাসজী মহারাজকে একবার পরীক্ষার জন্য এক নারীকে পাঠানো হয়েছিল। তিনি সত্যি কামজয়ী কিনা পরীক্ষা করার জন্য।
শ্রী সন্তদাসজী মহারাজের লেখা স্বামী রামদাস কাঠিয়া বাবাজীর জীবন চরিতে দেখতে পাই – স্ত্রীলোক বললেন, ‘মহারাজ, তুমকো যবসে হম দেখিথি, তবসে তুমহারা পর হমারি মন চলনে লাগা। তুম হমারি পর কির্পা করো।‘
তখন, শ্রী রামদাসজী বলেছিলেন, ‘……গরীবদাস তু হিয়াসে জরা হঠ যা… তব ইসিকো মালুম পড়েগা সাধুকা সামর্থ ক্যায়সা হোতা হ্যায়।‘
সেই রমণী তখন অতিশয় ভীতা হয়ে তার পায়ে পড়েছিলেন। ক্ষমা চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ব্রজবাসীগণ তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছিলেন।
শ্রী রামদাসজী তাকে ক্ষমা করে বলেছিলেন, ‘ আচ্ছা চলা যা… সব সাধু বরাব্বর নেহি হোতা হ্যায়, কোই যোগীরাজ ভি হোতা হ্যায়।‘
নারীদের তারা মাতৃরূপে –কন্যারূপে দেখেন। শ্রীজানকীদাসজী, বাবাজী ছিলেন যোগীরাজ।
বাবাজী মহারাজ গীতার একটি শ্লোকের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন – ‘ধর্মাচরণের সময়ও আমরা যেন কাম, ক্রোধ ও লোভ – এই তিন শত্রু থেকে সাবধান থাকি।
কারণ, অনেক সময় ধর্মের নাম নিয়েও ব্যভিচার সংগঠিত হয়।‘
বাবাজী মহারাজ তার স্কুল জীবনের নানা কথার সঙ্গে এক মুসলমান মহিলার কথা বলতেন। তিনি বাবাজীকে মাতৃস্নেহে খাবার দিতেন। বাবাজী যেহেতু ব্রাম্ভন ছিলেন, তাই ওই মুসলমান মহিলা তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতেন, বাপজান আগে খেয়ে নে, পরে বড় হয়ে জাত মানিস।
বাবাজী মহারাজের কাছে ওই মহিলা হিন্দু, কি মুসলমান – সেটা বড় ছিল না। তিনি ওই রমণীর মধ্যে দেখেছিলেন এক বিশুদ্ধ মাতৃরূপ। আর মায়ের কোন জাত থাকে না।
তাই বাবাজী বলতেন, এই পৃথিবীতে তোদের দেখার দায়িত্ব যিনি তোদের পাঠিয়েছেন, তার। দেখিস না, সন্তান জন্মের সময়েই মাতৃস্তনে দুগ্ধ দিয়ে তোদের ক্ষুধা নিবৃত্তির ব্যবস্থা তিনি আগেই করে রেখেছেন। নারীর মধ্যে এই মাতৃরূপের প্রকাশ তিনি বার বার দেখেছেন।
বাবাজী বলেছেন, মা ছাড়া গতি নাই, তিনি দেবী হতে পারেন, চিন্ময়ী হতে পারেন, মৃন্ময়ী হতে পারেন। তাই ‘দূর্গাপূজা’ নিবন্ধে তিনি লিখছেন – কোন বৈষ্ণব যদি মনে করেন, কৃষ্ণভক্তের দূর্গাপূজার প্রয়োজন নাই, তাহলে ভুল হবে।
কারণ, মায়ের কৃপা ছাড়া যুদ্ধলাভ করা যায় না। এর মানে হল, সাধকও শ্রীভগবানকে লাভ করতে পারেন না, মায়ের কৃপা ছাড়া। স্বয়ং ব্রম্ভা শ্রীরামচন্দ্রকে বলেছিলেন ‘আদ্যাশক্তির কৃপাদৃষ্টি ছাড়া রাবণ বধ সম্ভব নয়।‘
বিষ্ণুর যে মোক্ষদায়িনী শক্তি, সেটাই মা, সেটাই গুরুশক্তি। তাই মা চন্ডী হলেন গুরু।‘
মথুরা থেকে নতুনগ্রামে আসার আগে বাবাজী গিয়েছিলেন গুরুভাই বাসুদেব চক্রবর্তীর বাড়ি। সেদিন বাস চলছিল না। তাই ঠিক করলেন দেবীপুরেই যাবেন।
সেখানেই গিয়েছিলেন। স্টেশনের কাছেই বাসুদেববাবুর বাড়ি। বাড়িতে স্ত্রী ও পুত্র। সেদিন রাতে প্রসাদ নেওয়ার পর বাসুদেব বাবু বাবাজীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এখন আপনার চলবে কী করে?’
বাবাজী মহারাজ বলেছিলেন, কেন সন্ন্যাসীদের তো মাধুকরী করার নিয়ম আছে। আমি মাধুকরী করব।‘
এরপর তিনি বাসুদেববাবুকে বলেছিলেন, আমি কমলাদির কাছ থেকেই প্রথম মাধুকরী গ্রহণ করব।‘ কমলাদি অর্থাৎ কমলা চক্রবর্তী ছিলেন বাসুদেববাবুর স্ত্রী এবং শ্রীজানকীদাসজীর শিষ্যা ও স্নেহধন্যা।
বাবাজী মহারাজকে এই কমলাদেবী মাধুকরীর ঝোলা বানিয়ে দিয়েছিলেন। আর একটি কাঁসার থালায় কেজি দুয়েক চাল ভিক্ষারূপ দিয়ে শুরু করালেন প্রথম মাধুকরী।
দেখুন, বাবাজীর জীবনে এই সমস্ত নারীরা কীভাবে এসেছেন। আর এক নারীর কথা বাবাজী সারা জীবন মনে রেখেছিলেন। তিনি হলেন গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা প্রীতি চট্টোপাধ্যায়। বাবাজীর তখন ভালো জামা-প্যান্ট নেই।
ছেঁড়া জামা-প্যান্ট পড়ে সামনের বেঞ্চে বসতে লজ্জা পেতেন, তাই পিছনের বেঞ্চে বসতেন। এই প্রীতিদেবীই বাবাজীকে প্রধান শিক্ষক দেবেনবাবুর কাছে নিয়ে গিয়ে বাবাজীর ফ্রিশিপ করে দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন আর এক শিক্ষক অসীম চট্টোপাধ্যায়।
বাবাজী ৫ মাইল রাস্তা হেঁটে স্কুলে যেতেন। প্রীতি দিদিমনি তার দুই ছেলেকে নিয়ে রিক্সায় স্কুলে আসতেন। তিনি বাবাজীকে হেঁটে যেতে দেখে, তাকে কোলে তুলে নিয়ে স্কুলে যেতেন।
ছোটবেলায় এই সমস্ত নারীদের মাতৃরূপ তাকে নারীদের প্রতি এক তীব্র সম্মানবোধের জন্ম দিয়েছিল।
তাই সন্ন্যাস নেওয়ার পরও তিনি নারীদের দূরে রাখেন নি। মাতৃরূপে, কন্যারূপে তিনি তাদের দেখেছেন। আশ্রমে অনেকেই ঠাকুমা ও পিসিমাকে দেখেছেন। বাবাজী মহারাজ এদের খুব সম্মান করতেন। তিনি থাকতে এনাদের কোন কষ্ট ছিল না।
যাইহোক, বাবাজী মহারাজ মহিলাদের বলতেন, আপনারা আমায় প্রণাম করলে উবু হয়ে করবেন আর পুরুষদের বলতেন, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে। কন্যাসমা নারীদের তিনি পদসেবা করার সুযোগ দিয়েছিলেন। আশ্রমের ছোট ছোট মেয়েদের তিনি সন্তানের মতো দেখতেন। এমনকি বড় হবার পর তাদের বিয়ের ব্যাপারেও সাহায্য করেছিলেন।
নারী রূপের মধ্যেই লুকিয়ে আছে দেবীরূপ। তারাই এই সৃষ্টিকে বজায় রেখেছেন। তাই বাবাজী মহারাজের কাছে নারীরা দেবীর রূপেই বিবেচিত হত।
সন্ন্যাস গ্রহণ করে তিনি পূর্বাশ্রম ছেড়ে এসেছিলেন, তাই কোনদিন তার জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে মুখোমুখী দেখা করেন নি, কিন্তু, এই জগতের সব নারীরাই তার কাছে হয়ে উঠেছিলেন মৃন্ময়ী দেবী, মাতৃরূপা।