আশ্রমে পৌঁছানো মাত্র বাবাজী মহারাজ শিষ্য, ভক্তদের বলতেন – আসতে কষ্ট হয়নি তো? যা আগে প্রসাদ পেয়ে নে

মনে পড়ে যায়, জীবনের তাপে ক্লান্ত হয়ে পড়লে, আমাদের যাবার একটা আশ্রয় আছে। আর সেখানে একবার গিয়ে পড়লে শান্তি। সব কষ্ট উধাও। এখন সেই আশ্রম আছে ঠিকই, কিন্তু, আশ্রয় আছে কি? আছে কি – সেই কথা - এতো দেরি হল? আসতে কষ্ট হয়নি তো, নে আগে মুখে কিছু দিয়ে নে।
খনো চোখের সামনে ভাসে সেই সৌম্য মূর্তি, অসাধারণ দুটি দীপ্ত চোখ আর সুমধুর কন্ঠের কয়েকটি কথা। দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত শিষ্য-ভক্তরা তখন তপোবন আশ্রমের মরুদ্যানে। বাবাজীর দর্শন পাওয়ামাত্র কোথায় হারিয়ে গেছে, পথের ক্লান্তি। 
আর বাবাজী মহারাজ তখন বলে চলেছেন, কিরে, এতো দেরি হল? আসতে কষ্ট হয়নি তো, নে আগে মুখে কিছু দিয়ে নে। 
এই কথাগুলো শ্রীবাবাজীর কাছ থেকে শোনেন নি, এমন মানুষজন খুব কম আছেন।
 আজ আমার মনে পড়ে সেই স্মৃতি। জানি, যারা এই লেখা পড়ছেন, তাদেরও সেই একই অভিজ্ঞতা হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। কারণ, বাবাজী মহারাজকে সবাই্কে ভালোবাসতেন নিজের পিতার মতো। আজ দীর্ঘ ৯ বছর পার হয়েও, তাদের সেই ভালোবাসা যেমন অমলিন, তেমনই বাবাজীর স্নেহ-দৃষ্টিও। 
আজ মনে পড়ে, প্রখর গ্রীষ্মে, রুক্ষ মাটি থেকে যখন বেরিয়ে আসছে গরম ভাপ, বাতাসে যখন আগুন-নিশ্বাস, পাখিরাও ভুলে গেছে ডাকতে – সেই সময় নতুনগ্রামের তপোবন আশ্রমে এক অদ্ভুত শীতলতা, ঠিক বাবার কন্ঠের মতো, তার দু-চোখের মতো। গ্রীষ্মের দুপুরে, আমবাগানে তখন পাকা আমের সুরভি। আর সেই আম শিষ্যদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে বাবার কী যে আনন্দ হতো, তা বলে বোঝানো যায় না। আর দুপুরে ভক্তদের পাতে পড়তো শীতল দই।
এক একদিন রাতে মালপোয়া। আর সেই মালপোয়ার কী স্বাদ! বাজারে কোনদিন এরকম মালপোয়া আজ পর্যন্ত খাই নি। সন্ধ্যাবেলায় প্রবচনে বসে বাবা, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের জন্য লজেন্সের বড় বড় কৌটো হাট করে খুলে দিতেন।
 শিশুরা যখন দু-হাত ভরে সেই লজেন্স নিত, বাবার মুখে খেলে যেত এক পরিতৃপ্তির হাসি। এসব কথা লিখছি কেন জানেন – স্মৃতি মাঝে মাঝে খুব কষ্ট দেয়। মনে পড়ে যায়, জীবনের তাপে ক্লান্ত হয়ে পড়লে, আমাদের যাবার একটা আশ্রয় আছে। আর সেখানে একবার গিয়ে পড়লে শান্তি। সব কষ্ট উধাও। এখন সেই আশ্রম আছে ঠিকই, কিন্তু, আশ্রয় আছে কি? আছে কি – সেই কথা - এতো দেরি হল? আসতে কষ্ট হয়নি তো, নে আগে মুখে কিছু দিয়ে নে।
বাবাজী মহারাজের কাছে কেউ দীক্ষা নেওয়ার কথা বললে, বাবা বলতেন – আমি অতি সাধারণ এক দীন মানুষ। আমার কাছে দীক্ষা নেওয়ার চেয়ে নবদ্বীপে অনেক ভালো গোঁসাই আছেন, তাদের কাছে নেবেন।
 বাবার এই কথায় অহঙ্কার ছিল না, ছিল এক পরম জ্ঞানী বৈষ্ণবের তৃণতূল্য বিনয়। তবে, বাবাজী মহারাজ খুব কম মানুষকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন দীক্ষা না দিয়ে। আসলে তিনি যাচাই করে নিতেন – কার মনোভূমি তৈরি, আর কার নয়। তিনি বুঝে নিতেন, অন্তরের টানে কারা সত্যিই দীক্ষা নিতে এসেছেন। একবার এক ব্যক্তি এসেছেন হুগলি থেকে, সঙ্গে আরো কয়েকজন।
 বাবার সঙ্গে রীতিমতো তর্কাতর্কি করছেন – আজই দীক্ষা দিতে হবে বলে। বাবাজী তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন, আজ সম্ভব নয়, আগে ভেবে নে ক’দিন, তারপর আসিস দীক্ষা দেব। 
তারা নাছোড়বান্দা। 
বাবা সেদিন তাদের দীক্ষা দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু পরে এক প্রবচনে বলেছিলেন, গুরুকে দিয়ে জোর করে কিছু বলাতে বা করাতে নেই – তাহলে ফল সুখদায়ক হয় না। আমি সেই ভদ্রলোককে চিনি। এখন তিনি অন্য গুরু নিয়েছেন। ভুলে গেছেন বাবার কথা। 
এদের জন্যই বাবা শ্মশান বৈরাগ্যের কথা বলতেন। 
আর বলতেন –দু ধরণের মন্ত্র আছে। এক হুজুগে মন্ত্র আর দুই- বুক ঠোকা মন্ত্র। সকলেই মন্ত্র নিচ্ছে, আমিও বাদ যাই কেন, আমিও মন্ত্র নিয়ে নিই- এমন্ত্রে জোর নেই। এহল হুজুগে মন্ত্র। এ পেতেও যতক্ষণ, আর যেতেও ততক্ষণ। আর বুক ঠোকা মন্ত্র হল, যে মন্ত্র বুকে বাসা বাঁধে, মরে গেলেও যায় না।
মন্ত্র দেওয়ার ব্যাপারে কবীরদাস বলতেন – “শীষ উতারে ভুই ধরে উপর রাখে পাও/দাস কবীরা এ কহে জো এয়সা হো তো আও।“ 
বাবাজী মহারাজ নতুনগ্রামে আসার পর অনেকের ধারণা হয়েছিল, তিনি বোধহয় কবচ, মাদুলি দেন। শিশির কুমার ঘোষালের গ্রন্থ থেকে  জানতে পারি – অনেকেই বাবাজীর কাছে মাদুলি-কবচের খবর নিতে আসতেন।
 বাবা তাদের সবিনয়ে বলেছিলেন – তিনি এই বিদ্যার অধিকারী নন, তার শ্রীগুরুদেবও এসব বিদ্যার ঘোর বিরোধী ছিলেন, তাই তিনিও এই বিদ্যা আয়ত্ত করেন নি। তিনি আর একটি কথা বলেছিলেন – ‘আমি শুধু কারো দুঃখের ভাগী হয়ে শ্রীভগবানের কাছে তাদের আরোগ্য কামনা করতে পারি।‘
একবার শিশিরবাবু বাবাকে বলে ফেলেছিলেন – ‘আপনি খুব ব্যস্ত।‘ বাবাজী বলেছিলেন, ‘দেখো, ব্যস্ত না হলে কোন কাজ হয় না।‘ শিশিরবাবু বুঝেছিলেন – সাধুর ব্যস্ততার সঙ্গে গৃহীর ব্যস্ততার অনেক পার্থক্য। সাধুর ব্যস্ততার মধ্যে উদ্বেগ থাকে না, থাকে কাজ শেষ করার তাগিদ। আর গৃহীর কাজ আজ বললে কাল হবে, আর কাল বললে, সেই কাজ কবে হবে ঠিক নেই। 
বাবাজী সময়কে ভীষণ মূল্য দিতেন। দিনের প্রতিটি মুহুর্ত তার হিসাব করা। আর নিয়মানুবর্তীতা ছিল তার আজন্ম। এই শিক্ষা তাকে দিয়েছিলেন তার শ্রীগুরু জানকীদাসজী মহারাজ। আশ্রমের প্রতিটি কাজ তাই ছিল সময়ের নিয়মে বাধা। 
 ভোর চারটেয় শ্রীশ্রী ঠাকুরজীর মঙ্গলারতি। তারপর গ্রামের শিশুদের গীতা পাঠদান। ভোর রাতে, শীত কিংবা গ্রীষ্ম হোক, এই শিশুরা আসত। দেখা গেছে, যে ছেলেরা পড়াশোনাতে খারাপ, তারাও গীতার সাংখ্য যোগ, ভক্তি যোগ ইত্যাদি অনায়াসে বলে যেতে পারত। আর এখানেই বাবাজীর সাফল্য। তিনি শিশুদের হৃদয়ভূমিকে তৈরি করতেন। 
 সাড়ে দশটায় শৃঙ্গার আরতি। তারপর বাবার সঙ্গে শিষ্য-ভক্তদের কথাবার্তা। বেলা বারোটায় ঠাকুরজীর রাজভোগ। বিকালে উত্থাপন। সন্ধ্যায় সন্ধারতি। আরতির পর স্তুতি, রাতে রাত্রীকালীন ভোগ ও শয়ন। এর আগে ভক্ত-শিষ্যদের প্রসাদ পাওয়া। বাবাজীর প্রবচন।
এ যেন এক সত্যি আশ্রম। আশ্রমে গেলে মনে হত- নাগরিক জীবন থেকে এসে পড়েছি সেই প্রাচীন আশ্রমিক পরিবেশে। হয়ত নাগরিক জীবনের সব সুবিধা এখানে আছে, কিন্তু, একই সঙ্গে আছে এক সত্যিকারের ঋষি। 
 শিশিরবাবুর লেখা থেকে আর একটি কথা জানতে পারি। বিষয়টা হল গয়লাদের দুধে জল মেশানো আর পরিমানে ফাঁকি দেওয়া। সেই কথাই শিশিরবাবু বলেছেন। বাবাজী মহারাজ  একদিন শান্তভাবে বসে আছেন আশ্রমের বারান্দায়। ঘোষেরা দুধ মাপছে। 
তারা জানতো, বাবাজী খুব শান্ত স্বভাবের। তাই নিজেদের ইচ্ছামতো দুধ মেপে চলেছে। বাবাজী দেখছেন দুধ কম দেওয়া হচ্ছে। তিনি বসে বসে হাসছেন। আচমকাই তিনি বলে উঠলেন – আপনারা অনেক দূর থেকে ঠাকুরজীর জন্য দুধ বয়ে এনেছেন। আপনারা ক্লান্ত, বিশ্রাম করুন। আমি মেপে নিচ্ছি।। 
আর একথা বলেই, তিনি ওদের হাত থেকে কেজি নির্দিষ্ট কৌটোটি নিয়ে দুধ মাপতে বসলেন।
গ্রামের জগতবাবু আর ছোটুবাবু দূরে দাঁড়িয়ে এসব লক্ষ্য করছিলেন। জগতবাবু ছোটুবাবুকে একেবারে ফিসফিস করে বললেন – এবার সন্ন্যাসীর আসল রূপ বেরিয়ে আসছে। ছোটুবাবু শুনে চলেছেন জগতবাবুর কথা। এতো বিষয়ী লোকের মতো ব্যবহার! 
গয়লারা চলে গেলে বাবাজী মহারাজ বললেন – ওরা আমাদের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে ভক্তের নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠানো অর্থ ঠকিয়ে নিয়ে যাবে, এটা ঠিক নয়। 
বাজারে ৮ টাকা কেজি দুধ। ভক্তরা এর জন্য ১০ টাকা দিচ্ছেন। তাই আমরাও ওদের সঙ্গে ১০ টাকা কেজি কিনছি, তা সত্বেও ওরা ঠকিয়ে নিচ্ছে। জগতবাবু, আপনিই বলুন, বসে বসে এটা দেখা কি ঠিক হত? 
উত্তর পেয়ে গেলেন জগতবাবু। বুঝলেন, ভক্ত যা ভগবানে নিবেদন করেছেন, সেই নিবেদিত বস্তুর অপচয়ে ভগবান ব্যথা পান।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad